কেন্দ্রে শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ তুলেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। এবার তারা গঙ্গাসাগর মেলাকে ঐতিহ্যের স্বীকৃতি প্রদানে অস্বীকার করেছে বলে সমালোচনা তীব্র হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনে গঙ্গাসাগর মেলার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতি বছর মকর সংক্রান্তির সময়ে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী এই মেলায় সমবেত হন। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ উৎসবকে ভারতের ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে কেন্দ্রীয় সরকারের অনীহা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
বিজেপি সরকারের এই সিদ্ধান্তের পিছনে ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ (এএসআই)-এর অজুহাত দেখানো হয়েছে বলে জানা গেছে। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, গঙ্গাসাগর মেলার ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব যথাযথভাবে প্রমাণিত নয়। এই যুক্তি অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। সমালোচকরা বলছেন, যেখানে কুম্ভ মেলা ইউনেস্কোর অস্পষ্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে এবং ভারত সরকারের পূর্ণ সমর্থন লাভ করেছে, সেখানে গঙ্গাসাগর মেলার প্রতি এই উদাসীনতা বাংলার সংস্কৃতির প্রতি পরিকল্পিত অবহেলার প্রমাণ।
গঙ্গাসাগর মেলা শুধু একটি ধর্মীয় সমাবেশ নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সাগরদ্বীপে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে গঙ্গা ও বঙ্গোপসাগরের সঙ্গমে পুণ্যস্নানের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে তীর্থযাত্রীরা আসেন। এই মেলার ঐতিহাসিক গুরুত্বও কম নয়। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, ভগীরথের তপস্যার ফলে গঙ্গা পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন এবং এই স্থানে তাঁর সাগরের সঙ্গে মিলন ঘটে। এই পৌরাণিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্য সত্ত্বেও কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে বাংলার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এই ঘটনাকে হাতিয়ার করে বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেছে। তৃণমূল নেতৃত্বের দাবি, বিজেপি সরকার বাংলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বারবার অবমাননা করছে। এক তৃণমূল নেতা বলেন, “কুম্ভ মেলা যদি ঐতিহ্য হতে পারে, তাহলে গঙ্গাসাগর মেলা কেন নয়? এটা বাংলার প্রতি বিজেপির পরিকল্পিত বৈষম্য।” তাঁরা আরও অভিযোগ করেছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বাংলার উন্নয়ন প্রকল্পে তহবিল বরাদ্দের ক্ষেত্রেও একই ধরনের অবহেলা দেখা যাচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যমে এই বিষয়টি নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকে লিখেছেন, “বিজেপি সরকার বাংলার সংস্কৃতির প্রতি আক্রমণ চালাচ্ছে। এবার জবাব দেওয়ার সময় এসেছে।” বাংলার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনও এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমেছে। একটি সংগঠনের প্রতিনিধি বলেন, “গঙ্গাসাগর মেলা আমাদের গর্ব। এটাকে অস্বীকার করা মানে বাঙালির পরিচয়ের ওপর আঘাত।” বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব এই অভিযোগের জবাবে বলেছে, এটি রাজনৈতিকভাবে উসকানো হচ্ছে। তাঁদের দাবি, গঙ্গাসাগর মেলার ঐতিহ্য স্বীকৃতি না পাওয়ার পিছনে কোনো বৈষম্য নেই, বরং এটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার অংশ। এক বিজেপি নেতা বলেন, “এএসআই-এর নিয়ম অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তৃণমূল এটাকে রাজনৈতিক রঙ দিচ্ছে।” তবে এই বক্তব্য বিরোধীদের ক্ষোভ কমাতে পারেনি।
গঙ্গাসাগর মেলার গুরুত্ব শুধু ধর্মীয় নয়, এটি অর্থনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। মেলার সময় স্থানীয় ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক এবং পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের আয় বৃদ্ধি পায়। এই মেলাকে ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর প্রচার বাড়ত এবং রাজ্যের পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ হতো। সমালোচকরা বলছেন, বিজেপি সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাংলার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ওপরও আঘাত হানছে।
এই ঘটনা আগামী দিনে রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়াতে পারে। তৃণমূল এই বিষয়টিকে জনগণের মধ্যে তুলে ধরে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচার জোরদার করতে পারে। অন্যদিকে, বিজেপি এই অভিযোগকে রাজনৈতিক চক্রান্ত বলে পাল্টা আক্রমণ করছে। বাংলার জনগণের মধ্যে এই বিতর্ক কীভাবে প্রভাব ফেলবে, তা সময়ই বলবে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট—গঙ্গাসাগর মেলার প্রতি কেন্দ্রের এই উদাসীনতা বাঙালির মনে গভীর ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।