ভারতের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভাঙ, যা হোলি ও মহাশিবরাত্রির মতো উৎসবগুলিতে ঠান্ডাই বা লস্যির সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহৃত হয়। ভারতীয়দের কাছে এটি শুধু একটি পানীয় নয়, বরং এক ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির প্রতীক। তবে, ভাঙ কেন ক্যানাবিসের অন্যান্য উপপণ্য থেকে আলাদা এবং বৈধ? ভারতের আইন কীভাবে ভাঙকে বৈধ রেখেছে, যখন গাঁজা ও চরস নিষিদ্ধ? আসুন, এই প্রবন্ধে আমরা ভাঙের বৈধতা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, এবং এর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিস্তারিত জানব।
ভাঙ, গাঁজা ও চরসের মধ্যে পার্থক্য:
ক্যানাবিস গাছের তিনটি প্রধান উপপণ্য রয়েছে: ভাঙ, গাঁজা ও চরস। এগুলি গাছের ভিন্ন অংশ থেকে তৈরি হয় এবং তাদের প্রক্রিয়াজাতকরণের পদ্ধতিও আলাদা।
ভাঙ: ভাঙ ক্যানাবিস গাছের পাতা এবং বীজ থেকে তৈরি হয়। পাতা ও বীজ প্রথমে গুঁড়ো করে পেস্টে পরিণত করা হয়, এরপর দুধ, চিনি এবং মশলা মিশিয়ে জনপ্রিয় ভাঙ ঠান্ডাই বা ভাঙ লস্যি তৈরি করা হয়। এটি মিষ্টি খাদ্যেও যোগ করা হয় যেমন জালেবি ও হালওয়া। কারণ এটি ক্যানাবিস গাছের পাতা এবং বীজ থেকে তৈরি হয়, ভারতীয় আইনে এটি মাদক দ্রব্য হিসেবে গণ্য নয়, তাই এটি বৈধ।
গাঁজা: গাঁজা ক্যানাবিস গাছের শুকনো ফুল (বাড) থেকে তৈরি হয়। সাধারণত এটি ধোঁকা হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে এটি ভারতের মাদক দ্রব্য ও মানসিক প্রভাবিত পদার্থ আইন (NDPS) 1985 এর অধীনে নিষিদ্ধ।
চরস: চরস বা হ্যাশিশ, ক্যানাবিস গাছের ফুল থেকে রেজিন বের করে তৈরি হয়। এটি গাঁজার মতোই নিষিদ্ধ, কারণ এটি ক্যানাবিসের ফুল থেকে তৈরি। এখানে মূল পার্থক্য হল যে, ভাঙ পাতা ও বীজ থেকে তৈরি হওয়ায় এটি আইনি বৈধতা পাচ্ছে, কিন্তু গাঁজা ও চরস ফুল থেকে তৈরি হওয়ায় তা নিষিদ্ধ।
আইন অনুযায়ী, ভাঙ ক্যানাবিস গাছের পাতা ও বীজ থেকে তৈরি হওয়ায় এটি মাদক দ্রব্যের আওতায় পড়ছে না, আর তাই এটি বৈধ।
ভাঙের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব:
ভাঙ ভারতের ইতিহাস এবং সংস্কৃতিতে একটি প্রাচীন উপাদান। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র যেমন অথর্ববেদ (খ্রিষ্টপূর্ব 1500-1000) এ ভাঙকে পবিত্র পাঁচটি গাছের একটি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি আধ্যাত্মিক ও ঔষধি গুণাবলী জন্য পরিচিত ছিল, এবং বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হত।
আশ্বিন সাংঘী এর মতে, আথর্ববেদে ভাঙকে “আলস্য দূর করার জন্য এক উত্তম গাছ” বলা হয়েছে। তিনি বলেন, “১০ম শতাব্দীতে ভাঙকে ‘দেবতাদের খাদ্য’ বলা হয়েছিল এবং ১৬শ শতাব্দীতে এটি অমৃতের মতো বলা হয়েছিল।”
এছাড়া, ভাঙ সম্পর্কিত একটি প্রাচীন সংস্কৃত নাটকে ভাঙকে মহামূল্যবান খাবার হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এভাবে ভাঙ ভারতের ঐতিহ্য, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকতা থেকে আবদ্ধ।
ভাঙ ও হিন্দু ধর্ম
ভাঙ ক্যানাবিস গাছের সাথে সম্পর্কিত এবং এটি শিব ভক্তি বিশেষ অংশ হয়ে উঠেছে। কিংবদন্তি অনুযায়ী, মহাদেব একবার তাঁর পরিবারে বিতর্কের পর একটি ক্যানাবিস গাছের নিচে আশ্রয় নেন এবং সেখানকার পাতা খেয়ে শান্তি লাভ করেন। এমনকি, মহাশিবরাত্রির সময় শিবের পূজা এবং ভাঙ পানীয়ের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, শিব বিষ পান করার পর শীতলতা পেতে ভাঙ পান করেছিলেন, যা তাকে শীতলতা প্রদান করে।
ভাঙ কেন বৈধ?
ভারতের NDPS Act, ১৯৮৫ ভাঙকে মাদক দ্রব্য হিসেবে নিষিদ্ধ করেনি। কারণ এটি কেবল ক্যানাবিস গাছের পাতা এবং বীজ থেকে তৈরি হয়, যা মাদক হিসেবে গণ্য নয়। ফলস্বরূপ, ভাঙ বৈধ এবং রাজ্য সরকারের লাইসেন্সের মাধ্যমে এটি বিক্রি করা হয়।
ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে যেমন উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ এবং কর্ণাটক, সরকার অনুমোদিত দোকানগুলোতে ভাঙ ঠেকা নামে ভাঙ বিক্রি হয়। এখানে কড়াকড়ি নিয়মাবলী অনুসরণ করা হয় এবং পণ্যটির গুণগত মান নিশ্চিত করা হয়। বিশেষ করে দিল্লি এবং নোয়দা অঞ্চলে হোলি ও শিবরাত্রি উৎসবের সময় এসব দোকানে ব্যাপক চাহিদা দেখা যায়।
ভাঙ, যা ভারতীয় সংস্কৃতির অংশ, তা মাদক হিসেবে নিষিদ্ধ নয়। এটি ঐতিহ্য, ধর্মীয় আচার, এবং সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ভাঙের বৈধতা ভারতের আইন ও সংস্কৃতির মধ্যে একটি বিশেষ স্থান ধারণ করেছে। এটি কেবল একটি মাদক দ্রব্য নয়, বরং ভারতীয় জনগণের ঐতিহ্য এবং আধ্যাত্মিকতার সাথে গভীরভাবে যুক্ত।