Syria civil war update: সিরিয়ায় রক্তাক্ত সংঘাত! নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে ১৩০০’র বেশি নিহত

সিরিয়ার (Syria) পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে গত কয়েকদিনে নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনী এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সমর্থক সেনাদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষে বেসামরিক নাগরিকসহ ১৩১১ জনেরও বেশি…

Syria civil war update

short-samachar

সিরিয়ার (Syria) পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে গত কয়েকদিনে নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনী এবং প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সমর্থক সেনাদের মধ্যে তীব্র সংঘর্ষে বেসামরিক নাগরিকসহ ১৩১১ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গত বছরের ডিসেম্বরে আসাদের পতনের পর এটিই দেশটিতে সবচেয়ে ভয়াবহ হতাহতের ঘটনা। যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা ‘সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস’ জানিয়েছে, এই সংঘাতে ৮৩০ জন বেসামরিক নাগরিক, ২৩১ জন নিরাপত্তা রক্ষী এবং ২৫০ জন আসাদপন্থী সেনা নিহত হয়েছেন। লাটাকিয়া, জাবলেহ ও বানিয়াস শহরে ছড়িয়ে পড়া এই সহিংসতা সিরিয়ার সংখ্যালঘু আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের ওপর গণহত্যার আকার নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

   

এই রক্তক্ষয়ী ঘটনার সূত্রপাত ঘটে গত বৃহস্পতিবার। সিরিয়ার পশ্চিম উপকূলের লাটাকিয়া ও জাবলেহ শহরে নিরাপত্তা রক্ষী বাহিনীর ঘাঁটিতে আসাদপন্থী সেনারা অতর্কিত হামলা চালায়। এই হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত হন। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, আসাদের সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ঘাইয়াথ দাল্লাহ’র নেতৃত্বে এই হামলা পরিকল্পিত হয়েছিল। জবাবে শুক্রবার ও শনিবার নিরাপত্তা রক্ষীরা ব্যাপক প্রতিশোধমূলক অভিযান শুরু করে। এই অভিযানে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় কিছু সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যারা আসাদপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেয়।

সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন নেতা আহমেদ আল-শারা, যিনি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘হায়াত তাহরির আল শাম’ (এইচটিএস)-এর প্রধান, টেলিভিশনে প্রচারিত এক ভাষণে ‘আসাদের বিশ্বস্তদের’ খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে তিনি তার বাহিনীকে অতিরিক্ত বা অযৌক্তিক প্রতিক্রিয়া থেকে বিরত থাকার নির্দেশও দিয়েছেন।

গত ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদ পালিয়ে যাওয়ার পর সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করে এইচটিএস। এই সময় নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক সদস্য বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও, আসাদপন্থী কিছু সেনা গোষ্ঠী প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, আসাদের কয়েকজন প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করছিলেন। বৃহস্পতিবারের হামলা ছিল সেই পরিকল্পনারই একটি অংশ।

নিরাপত্তা বাহিনী এই হামলার জবাবে পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক অভিযান শুরু করে। এই অভিযানের সময় আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের বেসামরিক নাগরিকদের ওপরও আক্রমণ চালানো হয়। সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, এই অঞ্চলে গত কয়েকদিনে গণহত্যার ঘটনায় শত শত আলাওয়াইত নিহত হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, বিদেশি বিদ্রোহী যোদ্ধারা তাদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে হত্যা ও লুটপাট করেছে।

বানিয়াস শহরের হাই আল কুসর এলাকার বাসিন্দা মোহামেদ ফারেস বিবিসিকে বলেন, “আমি দেখেছি একাধিক পরিবারের সদস্যরা তাদের ঘরের ভেতর গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে আছে। কেউ কেউ বাঁচতে ছাদে উঠেছিল, সেখানেও তাদের গুলি করা হয়েছে।” আরেক বাসিন্দা আলী জানান, “তারা আমাদের বাড়িতে ঢুকে সব টাকা নিয়ে গেছে। আমার প্রতিবেশীর গাড়ি, স্বর্ণ আর টাকা লুট করেছে। তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছিল তারা উজবেক বা চেচেন।”

আলাওয়াইতরা শিয়া মুসলিমদের একটি উপ-সম্প্রদায়, যারা সিরিয়ার জনসংখ্যার প্রায় ১০%। বাশার আল-আসাদ নিজেও এই সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। গত ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধে আসাদের বাহিনী সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। আলাওয়াইত সম্প্রদায়ের শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, নির্যাতন ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে আসাদের পতনের পর সুন্নিদের মধ্যে আলাওয়াইতদের প্রতি জাতিগত বিদ্বেষ বেড়েছে। এই বিদ্বেষই সাম্প্রতিক হামলার একটি বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

আসাদের পতনের পর থেকে সিরিয়ায় অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। অনেকে এর জন্য দায়ী করেন অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সিদ্ধান্তকে। তিনি সেনাবাহিনী, পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী ভেঙে দিয়েছেন, যার ফলে হাজার হাজার কর্মকর্তা চাকরি হারিয়েছেন। এছাড়া, সরকারি চাকরিজীবীদেরও ব্যাপকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। সিরিয়ার ৯০% মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করে, এবং বেকারত্বের হার আকাশছোঁয়া। এমন পরিস্থিতিতে দেশে বিক্ষোভ ও সংঘাত ছড়িয়ে পড়া অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

আহমেদ আল-শারার ইসলামপন্থী বাহিনী ক্ষমতায় থাকলেও, তিনি সব বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। সিরিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও বিদেশি যোদ্ধাসহ কট্টরপন্থী ইসলামি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলো আলাওয়াইতদের ওপর হামলায় জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।

সিরিয়ার পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল আলাওয়াইতদের ঐতিহ্যবাহী আবাসস্থল। এই সংঘাতের ফলে এলাকাটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জল সরবরাহ বন্ধ, রাস্তাঘাট অবরুদ্ধ। সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা জানিয়েছে, স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সরকারি বাহিনী অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করেছে। তবে, স্থানীয়রা আতঙ্কে রয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিরিয়াকে স্থিতিশীল করতে বিদেশি যোদ্ধাদের প্রত্যাহার এবং একটি নিরপেক্ষ সংবিধান প্রণয়ন জরুরি। এমন একটি সংবিধান প্রয়োজন, যা ধর্ম বা সম্প্রদায় নির্বিশেষে সব সিরিয়ানের অধিকার সুরক্ষিত করবে। নইলে, এই ধরনের সংঘাত ও প্রতিশোধের চক্র চলতেই থাকবে।

সিরিয়ার এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষ দূত গিয়ের পেডারসেন বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। ফ্রান্স এই হামলাকে ‘ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে বেসামরিকদের ওপর আক্রমণ’ হিসেবে নিন্দা করেছে। সিরিয়ার সমর্থকরা আশা করছেন, দেশটি শীঘ্রই এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসবে। তবে, বর্তমান পরিস্থিতি সে পথকে দীর্ঘ ও কঠিন করে তুলেছে।