ইন্দো-প্যাসিফিক (Indo-Pacific Security) অঞ্চলে চিনের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের মুখে জাপান এবং ফিলিপাইন তাদের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক ডিফেন্স ফোরামের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই সিদ্ধান্ত দক্ষিণ চিন সাগর এবং পূর্ব চিন সাগরে চিনের ক্রিয়াকলাপ নিয়ে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে গৃহীত হয়েছে। আজ, রবিবার, ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকে জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেন নাকাতানি এবং ফিলিপাইনের প্রতিরক্ষা সচিব গিলবার্তো তেওদোরো প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর পরিকল্পনা তৈরি করেছেন। এই পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে সামরিক তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং যৌথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দুই দেশের সামরিক সম্পর্ককে আরও গভীর করা।
নাকাতানি এবং তেওদোরোর বৈঠকে উভয় দেশই চিনের একতরফা আচরণের বিরুদ্ধে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তেওদোরো জোর দিয়ে বলেছেন, “ফিলিপাইন জাপানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জোরদার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা চিন এবং অন্যান্য দেশের আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা ও বর্ণনা পরিবর্তনের একতরফা চেষ্টার বিরুদ্ধে একসঙ্গে দাঁড়াতে চাই।” নাকাতানি এই মতের সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, “আমরা অপারেশনাল সহযোগিতা বাড়াতে সম্মত হয়েছি। এর মধ্যে যৌথ এবং বহুপাক্ষিক প্রতিরক্ষা প্রশিক্ষণ, বন্দর পরিদর্শন এবং সামরিক তথ্য বিনিময় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।” ইন্দো-প্যাসিফিক ডিফেন্স ফোরামের মতে, দুই দেশ সামরিক তথ্য সুরক্ষার জন্য একটি প্রক্রিয়া স্থাপনের আলোচনাও শুরু করেছে।
দক্ষিণ চিন সাগর এবং পূর্ব চিন সাগরে চিনের ঘন ঘন আঞ্চলিক অনুপ্রবেশ এই সহযোগিতার পেছনে প্রধান কারণ। ফিলিপাইনের একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে (ইইজেড) চিনের জলকামান, জাহাজের ধাক্কা এবং অন্যান্য আগ্রাসী পদক্ষেপের ঘটনা বেড়েছে। জাপানও পূর্ব চিন সাগরে সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ (চিন এটিকে দিয়াওয়ু বলে দাবি করে) নিয়ে চিনের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে রয়েছে। উভয় দেশই এই আচরণের তীব্র নিন্দা করেছে এবং ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে একত্রে কাজ করার প্রতিশ্রুতি জানিয়েছে।
ইন্দো-প্যাসিফিক ডিফেন্স ফোরামের রিপোর্টে বলা হয়েছে, নাকাতানি এবং তেওদোরো বর্তমান নিরাপত্তা পরিবেশকে ‘ক্রমশ চ্যালেঞ্জিং’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তারা মনে করেন, এই পরিস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তেওদোরো বলেন, “আমরা এমন একটি অঞ্চল চাই, যেখানে আন্তর্জাতিক আইন এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান থাকবে। জাপানের সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্ব এই লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”
জাপান এবং ফিলিপাইন উভয়ই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক মিত্র। এই ত্রিপাক্ষিক সম্পর্ক তাদের প্রতিরক্ষা কৌশলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ২০২৪ সালে ফিলিপাইন এবং যুক্তরাষ্ট্র একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, যা সামরিক গোয়েন্দা তথ্য এবং প্রযুক্তি বিনিময়ের পথ খুলে দিয়েছে। এই চুক্তি ফিলিপাইনকে মার্কিন অস্ত্র ক্রয় এবং বড় আকারের যৌথ সামরিক মহড়ার সুযোগ করে দিয়েছে। জাপানেরও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘদিনের প্রতিরক্ষা চুক্তি রয়েছে, যা তাদের ৫০,০০০-এর বেশি মার্কিন সেনা মোতায়েনের অনুমতি দেয়।
এই ত্রিপাক্ষিক সহযোগিতা চিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। নাকাতানি বলেন, “আমাদের যৌথ প্রশিক্ষণ এবং তথ্য বিনিময় কেবল দ্বিপাক্ষিক নয়, বহুপাক্ষিক স্তরেও হবে। এতে আমাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।”
২০২৪ সালে স্বাক্ষরিত ‘রেসিপ্রোকাল অ্যাকসেস অ্যাগ্রিমেন্ট’ (আরএএ)-এর অধীনে জাপান এবং ফিলিপাইন তাদের সামরিক বাহিনীকে একে অপরের ভূখণ্ডে মোতায়েন করার সুযোগ পেয়েছে। এই চুক্তি প্রশিক্ষণ এবং মহড়ার জন্য পথ প্রশস্ত করেছে। জাপানের অস্ট্রেলিয়া (২০২২) এবং যুক্তরাজ্যের (২০২৩) সঙ্গেও এমন চুক্তি রয়েছে। নাকাতানি এবং তেওদোরো এই চুক্তির আওতায় সহযোগিতা আরও প্রসারিত করার বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
এই বৈঠকে দুই দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী একটি ‘হাই-লেভেল স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগ’ শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটি তাদের সামরিক বাহিনীর মধ্যে গভীরতর সমন্বয় এবং তথ্য ভাগাভাগি নিশ্চিত করবে। তেওদোরো বলেন, “এই অংশীদারিত্ব কেবল নিরাপত্তার জন্য নয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রতিরক্ষা শিল্পের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।”
জাপান এবং ফিলিপাইনের এই সহযোগিতা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। চিনের আগ্রাসী কার্যকলাপ, বিশেষ করে দক্ষিণ চিন সাগরে ফিলিপাইনের জাহাজের ওপর হামলা এবং পূর্ব চিন সাগরে জাপানি দ্বীপপুঞ্জের কাছে সামরিক মহড়া, এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, জাপান এবং ফিলিপাইনের মতো দেশগুলো তাদের প্রতিরক্ষা ক্ষমতা বাড়াতে এবং মিত্রদের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই সহযোগিতা চিনের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি ভারসাম্য তৈরি করতে পারে। একজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, “জাপান এবং ফিলিপাইনের এই পদক্ষেপ অন্যান্য দেশকেও অনুপ্রাণিত করতে পারে। এটি একটি বহুপাক্ষিক জোটের দিকে যেতে পারে, যা চিনের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।”
৯ মার্চ ২০২৫-এ ম্যানিলায় জাপান এবং ফিলিপাইনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের এই বৈঠক ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। চিনের আগ্রাসনের মুখে দুই দেশের এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য আশার আলো জাগিয়েছে। নাকাতানি এবং তেওদোরোর প্রতিশ্রুতি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন এই সহযোগিতাকে আরও শক্তিশালী করবে। ভবিষ্যতে এই অংশীদারিত্ব কীভাবে বিকশিত হয়, তা এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।