ওড়িশার জগৎসিংহপুর জেলার পারাদীপ মৎস্য বন্দরে (Paradip Fishing Port) গতকাল বৃহস্পতিবার এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে বেশ কয়েকটি নৌকা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, এই ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দমকল বাহিনীর একাধিক দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে তৎপরতার সঙ্গে কাজ শুরু করে। বর্তমানে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নেহরু বঙ্গলা মৎস্য বন্দরে এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। খবর পাওয়া মাত্রই দমকল বাহিনী ঘটনাস্থলে ছুটে যায় এবং আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। পারাদীপের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) নিরঞ্জন বেহেরা জানিয়েছেন, “পারাদীপ মৎস্য বন্দরে আগুন এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এই ঘটনায় কোনো হতাহতের আশঙ্কা নেই। আগুন নেভাতে ১০-১২টি দমকল গাড়ি মোতায়েন করা হয়েছিল।” তিনি আরও বলেন যে, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দমকল কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে।
স্থানীয়দের বয়ান অনুযায়ী, আগুন প্রথমে একটি নৌকায় লাগে এবং সেখান থেকে দ্রুত পাশের নৌকাগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনায় মোট ১২টি নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে ছয়টি ছিল বড় আকারের মাছ ধরার নৌকা এবং বাকি ছয়টি ছিল ছোট আকারের ভুটভুটি নৌকা। আগুনের তীব্রতা এতটাই প্রবল ছিল যে কয়েক মিনিটের মধ্যে বেশ কয়েকটি নৌকা সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যায়। স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জানিয়েছেন, নৌকাগুলিতে থাকা গ্যাস ট্যাঙ্ক এবং জ্বালানি তেল আগুনের বিস্তারকে আরও ত্বরান্বিত করেছে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “আমরা হঠাৎই ধোঁয়া দেখতে পাই এবং তারপরই আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যায়। আমরা চেষ্টা করেছিলাম আগুন নেভাতে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল।” তবে সৌভাগ্যবশত, ঘটনার সময় নৌকাগুলিতে কেউ উপস্থিত ছিল না, ফলে কোনো প্রাণহানি বা আহতের ঘটনা ঘটেনি।
এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সঠিক কারণ এখনও জানা যায়নি। প্রাথমিক তদন্তে ধারণা করা হচ্ছে যে, নৌকায় থাকা গ্যাস সিলিন্ডার বা জ্বালানি তেল থেকে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে। তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিস্তারিত তদন্তের পরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে। পারাদীপের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট বলেন, “আমরা ঘটনার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। তদন্ত চলছে এবং শীঘ্রই এর রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে।”
ঘটনার পর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়া রুখতে পুলিশ ও প্রশাসন তৎপরতার সঙ্গে কাজ শুরু করে। পারাদীপের পাঁচটি থানা থেকে পুলিশ কর্মীদের মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়াও, জগৎসিংহপুর জেলার সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তারা, যার মধ্যে পারাদীপের এডিএম এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট অন্তর্ভুক্ত, ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে স্থানীয়দের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন।
এডিএম নিরঞ্জন বেহেরা আরও বলেন, “আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে এবং এখন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের কাজ চলছে।” তিনি স্থানীয় মৎস্যজীবীদের শান্ত থাকার এবং প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।
পারাদীপ মৎস্য বন্দর ওড়িশার একটি গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য কেন্দ্র। এখানে প্রতিদিন শত শত মৎস্যজীবী মাছ ধরার জন্য সমুদ্রে যান এবং তাঁদের জীবিকা নির্ভর করে এই নৌকাগুলির উপর। এই অগ্নিকাণ্ডে বেশ কয়েকটি নৌকা ধ্বংস হওয়ায় অনেক মৎস্যজীবীর জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। একজন মৎস্যজীবী বলেন, “এই নৌকা আমাদের জীবনের সবকিছু। এটা পুড়ে গেলে আমরা কী করব? সরকারের কাছে আমরা সাহায্য চাই।”
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, একটি বড় নৌকার মূল্য প্রায় ১০-১৫ লক্ষ টাকা এবং ছোট নৌকার মূল্যও কয়েক লক্ষ টাকা। এই ক্ষতি পূরণ করা মৎস্যজীবীদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। তাঁরা সরকারের কাছে আর্থিক সাহায্য এবং ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন।
এই ঘটনার পর পারাদীপ মৎস্য বন্দরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নৌকাগুলিতে জ্বালানি তেল এবং গ্যাস সিলিন্ডার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আরও কঠোর নিয়মকানুন প্রয়োজন। এছাড়াও, বন্দরে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা আরও উন্নত করার দাবি উঠেছে।
প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে ব্যবস্থা নেব। মৎস্যজীবীদের ক্ষতি পোষাতে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।” তবে এখনও পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট সাহায্য প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়নি।
এই ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক মাধ্যমে অনেকে মৎস্যজীবীদের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। কেউ কেউ সরকারের কাছে দ্রুত পদক্ষেপের দাবি তুলেছেন। একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “পারাদীপের মৎস্যজীবীরা আমাদের খাদ্য সরবরাহের একটি বড় অংশ। তাঁদের এই দুর্দিনে সাহায্য করা আমাদের দায়িত্ব।”
পারাদীপ মৎস্য বন্দরে এই অগ্নিকাণ্ড একটি বড় দুর্ঘটনা হলেও, সময়মতো প্রশাসনের হস্তক্ষেপে প্রাণহানি এড়ানো গেছে। তবে এই ঘটনা মৎস্যজীবীদের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁদের ক্ষতি পূরণ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এই ঘটনা আমাদের সবাইকে সতর্ক করে দেয় যে, নিরাপত্তা ও সচেতনতাই এমন দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়।