ভারতীয় স্পিনার বরুণ চক্রবর্তীর (Varun Chakravarthy) জন্য দুবাই এখন আর শুধু একটি স্মৃতির জায়গা নয়, বরং তাঁর ক্রিকেটীয় জীবনের এক অসাধারণ প্রত্যাবর্তনের সাক্ষী। আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নিজের অভিষেক ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে বরুণ প্রমাণ করেছেন যে তিনি অতীতের ব্যর্থতাকে পিছনে ফেলে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাতে সক্ষম। ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে একই মাটিতে উইকেটশূন্য থাকার তিক্ত স্মৃতি এবং পাকিস্তানের কাছে ১০ উইকেটে হারের পর দলের ব্যর্থতার জন্য দায়ীদের মধ্যে একজন হিসেবে চিহ্নিত হওয়া বরুণের জন্য এই পারফরম্যান্স ছিল এক স্বপ্নের প্রত্যাবর্তন। রবিবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে তিনি শুধু নিজের দক্ষতার প্রমাণ দেননি, বরং ভারতীয় স্পিন আক্রমণের নতুন নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।
দুবাইয়ের দুঃস্বপ্ন থেকে গৌরবের পথে
২০২১ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বরুণের পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক। তিন ম্যাচে একটিও উইকেট না পাওয়া এবং বিশেষ করে পাকিস্তানের কাছে ১০ উইকেটে হারের পর তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন। ভারতের সেই বিশ্বকাপ অভিযান গ্রুপ পর্বেই শেষ হয়ে যায় এবং বরুণকে দায়ী করা হয় দলের ব্যর্থতার জন্য। কিন্তু ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনের গল্প যে কতটা অনুপ্রেরণাদায়ী হতে পারে, তা বরুণ দুবাইয়ের এই মাটিতেই দেখিয়ে দিলেন। গত বছর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে দুটি পাঁচ উইকেটের সাফল্যের পর এবার ওডিআই ক্রিকেটে তিনি তৃতীয়বারের জন্য পাঁচ উইকেট তুলে নিলেন, এবং তাও সেই দুবাইয়ে, যেখানে একসময় তাঁর স্মৃতি ছিল তিক্ত।
ম্যাচে নিউজিল্যান্ড ৩৫.৩ ওভারে ১৫১/৪-এর মতো শক্ত অবস্থানে ছিল। এখান থেকেই বরুণ তাঁর জাদু শুরু করেন। প্রথমে উইল ইয়ংকে আউট করে তিনি উইকেটের খাতা খোলেন। এরপর গ্লেন ফিলিপস, মাইকেল ব্রেসওয়েল, মিচেল স্যান্টনার এবং ম্যাট হেনরিকে একে একে প্যাভিলিয়নে ফেরান। ১০ ওভারে ৪২ রান দিয়ে ৫ উইকেট নিয়ে তিনি ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে নেন।
স্পিনারদের দাপটে নতুন রেকর্ড
বরুণের এই দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে সঙ্গ দিয়েছেন কুলদীপ যাদব, অক্ষর পটেল এবং রবীন্দ্র জাদেজা। এই তিন স্পিনার মিলে আরও চারটি উইকেট তুলে নেন, যার মধ্যে কুলদীপ দুটি উইকেট পান। ভারতীয় স্পিনারদের এই ম্যাচে মোট নয়টি উইকেট চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে এক ইনিংসে স্পিনারদের সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড। এর আগে ২০০৪ সালে পাকিস্তান কেনিয়ার বিরুদ্ধে এডবাস্টনে আটটি উইকেট নিয়েছিল।
বরুণের এই স্পেল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অভিষেকে দ্বিতীয় সেরা বোলিং ফিগার এবং ভারতীয় বোলারদের মধ্যে সেরা। অস্ট্রেলিয়ার জশ হ্যাজেলউড ২০১৭ সালে এডবাস্টনে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৬/৫২ নিয়ে এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন। এছাড়া, বরুণ তাঁর দ্বিতীয় ওডিআই ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিয়ে ভারতীয় বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত ফাইফারের রেকর্ড গড়েছেন। এর আগে স্টুয়ার্ট বিনি ২০১৪ সালে মিরপুরে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তৃতীয় ওডিআই-তে ৬/৪ নিয়েছিলেন। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ইতিহাসে রবীন্দ্র জাদেজার ২০১৩ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৫/৩৬-এর পর বরুণের এই স্পেল ভারতীয়দের মধ্যে দ্বিতীয় সেরা।
ম্যাচের গতিপ্রকৃতি
ম্যাচে টস জিতে নিউজিল্যান্ড প্রথমে বোলিং করার সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতের শীর্ষ ক্রম ব্যর্থ হয় এবং দল ৩০/৩-এ চলে যায়। এরপর শ্রেয়স আইয়ার (৭৯) এবং অক্ষর পটেলের (৪২ রান, ৬১ বলে, ৫ চার ও ১ ছক্কা) মধ্যে ৯৮ রানের জুটি দলকে লড়াইয়ে ফেরায়। তবে শ্রেয়স ও কেএল রাহুলের (২৩ রান, ২৯ বলে) বিদায়ে ভারত ১৮২/৬-এ নেমে যায়। শেষ দিকে রবীন্দ্র জাদেজা (১৬ রান, ২০ বলে) এবং হার্দিক পাণ্ড্যের (৪৫ রান, ৪৫ বলে, ৪ চার ও ২ ছক্কা) ৪১ রানের জুটি ভারতকে ৫০ ওভারে ২৪৯/৯-এ পৌঁছে দেয়। নিউজিল্যান্ডের পক্ষে ম্যাট হেনরি ৮ ওভারে ৫/৪২ নিয়ে দুর্দান্ত বোলিং করেন।
২৫০ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে নিউজিল্যান্ড নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারায়। কেন উইলিয়ামসন (৮১ রান, ১২০ বলে, ৭ চার) লড়াই চালিয়ে গেলেও বরুণের স্পিন জালে মিডল অর্ডার ধসে পড়ে। কুলদীপ ৯.৩ ওভারে ২/৫৬ নেন, অক্ষর, হার্দিক ও জাদেজা একটি করে উইকেট পান।
বরুণের মন্তব্য
ম্যাচের পর বরুণ বলেন, “প্রথমে আমি খুবই নার্ভাস ছিলাম। ওডিআই ফরম্যাটে ভারতের হয়ে বেশি ম্যাচ খেলিনি। কিন্তু খেলা যত এগিয়েছে, আমি ভালো বোধ করেছি। বিরাট, রোহিত, শ্রেয়স আর হার্দিক আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন, এটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।” তিনি জানান, ম্যাচের আগের রাতে তিনি জানতে পারেন যে তিনি খেলছেন। “দেশের হয়ে খেলার প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু নার্ভাসও ছিলাম। পিচ র্যাঙ্ক টার্নার না হলেও সঠিক জায়গায় বল করলে সাহায্য পাওয়া যাচ্ছিল। কুলদীপ, জাদ্দু, অক্ষর এবং পেসারদের বোলিংয়ে এটা পুরো দলের প্রচেষ্টা ছিল।”
বরুণ চক্রবর্তীর এই পারফরম্যান্স শুধু তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, ভারতীয় ক্রিকেটে স্পিনের শক্তিরও প্রমাণ। দুবাইয়ের এই মাটি, যেখানে একসময় তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন, এখন তাঁর গৌরবের সাক্ষী। তাঁর এই প্রত্যাবর্তন ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য এক অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে থাকবে।