মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বলেছেন, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর ভরসা করেন যে তিনি ইউক্রেনের সঙ্গে যে কোনও যুদ্ধবিরতি ( Ukraine ceasefire) মেনে চলবেন। একই দিনে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইউক্রেনের জন্য মার্কিন নিরাপত্তা গ্যারান্টির দাবি জানিয়েছেন। ইউরোপের নেতারা উদ্বিগ্ন যে, ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে একটি দ্রুত চুক্তি করে ইউক্রেনের স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারেন। এই সাক্ষাতে ট্রাম্প পুতিনের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব দেখিয়েছেন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে “স্বৈরশাসক” বলে তাঁর পূর্বের মন্তব্য থেকে সরে এসেছেন।
ট্রাম্প ও স্টারমার হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে একসঙ্গে বসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। ট্রাম্প বলেন, “আমি মনে করি পুতিন তার কথা রাখবেন। আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি, তাকে অনেকদিন ধরে চিনি। আমি বিশ্বাস করি না তিনি তার কথার খেলাপ করবেন।” তিনি আরও বলেন, “ব্রিটেন নিজেদের দেখতে পারে, তবে তারা যদি সাহায্য চায়, আমি সবসময় ব্রিটিশদের পাশে থাকব।” এই বক্তব্যের মাধ্যমে ট্রাম্প পুতিনের প্রতি তাঁর আস্থা প্রকাশ করলেও, স্টারমারের উদ্বেগের সঙ্গে এটি সাংঘর্ষিক। স্টারমার যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার পথে বিমানে বলেছিলেন, “মার্কিন সমর্থন ছাড়া যুদ্ধবিরতি হলে পুতিনকে আবার আক্রমণের সুযোগ দেওয়া হবে।” তিনি জোর দিয়েছেন যে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার আগ্রাসনের পুনরাবৃত্তি রোধে শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা জরুরি।
স্টারমারের প্রস্তাব ও ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া
ইউকে এবং ফ্রান্স ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছে। তারা চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে সমর্থন দিক—যেমন আকাশ ও উপগ্রহ নজরদারি এবং সম্ভাব্য বিমান শক্তি। স্টারমার ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বলেন, “আমি আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই যাতে এই শান্তি চুক্তি দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং কেউ যেন এটি ভঙ্গ করতে না পারে।” এই উদ্দেশ্যে তিনি ট্রাম্পকে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের একটি আমন্ত্রণপত্র দেন। এই আমন্ত্রণে ট্রাম্পকে যুক্তরাজ্যে একটি রাষ্ট্রীয় সফরের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো অভূতপূর্ব ঘটনা। স্টারমার বলেন, “এটি এর আগে কখনও ঘটেনি।”
ট্রাম্প, যিনি ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রতি তাঁর মুগ্ধতার কথা আগেও প্রকাশ করেছেন, এই আমন্ত্রণে খুশি হয়েছেন। তবে, এটি স্পষ্ট যে এই পদক্ষেপটি ট্রাম্পকে প্রভাবিত করার একটি কৌশল। ইউরোপের নেতারা আশঙ্কা করছেন যে, ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে দ্রুত চুক্তি করে ইউক্রেনের স্বার্থের বিনিময়ে রাশিয়ার পক্ষ নিতে পারেন। গত সপ্তাহে ট্রাম্প জেলেনস্কিকে “নির্বাচনবিহীন স্বৈরশাসক” বলে সমালোচনা করেছিলেন, যা ইউরোপে উদ্বেগ বাড়িয়েছিল। তবে, স্টারমারের উপস্থিতিতে তিনি এই মন্তব্য থেকে পিছিয়ে আসেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি হাসতে হাসতে বলেন, “আমি কি তাই বলেছিলাম? আমি বিশ্বাস করতে পারছি না আমি এটা বলেছি। পরবর্তী প্রশ্ন।”
ইউক্রেনের সঙ্গে সম্পর্ক ও খনিজ চুক্তি
শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে জেলেনস্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। এই বৈঠকে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে, যার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের বিরল খনিজ সম্পদে প্রবেশাধিকার পাবে। ট্রাম্প এটিকে মার্কিন সামরিক সাহায্যের “প্রতিদান” হিসেবে দেখছেন। জেলেনস্কি আশা করেছিলেন এই চুক্তিতে মার্কিন নিরাপত্তা গ্যারান্টি থাকবে, কিন্তু সূত্র জানাচ্ছে, তা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। ইউক্রেনের জন্য এই গ্যারান্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে জেলেনস্কি বারবার বলে এসেছেন। তিনি বলেন, “শক্তিশালী নিরাপত্তা ছাড়া যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে না।”
এদিকে, স্টারমারের সফরটি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রঁর সাম্প্রতিক সফরের কয়েকদিন পরে হচ্ছে। ম্যাক্রঁ ট্রাম্পের সঙ্গে “টার্নিং পয়েন্ট” হিসেবে বৈঠকটির কথা বললেও কোনো উল্লেখযোগ্য ফল পাননি। ট্রাম্প বহুদিন ধরে বলে আসছেন যে, ইউরোপীয় দেশগুলিকে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ও নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বেশি দায়িত্ব নিতে হবে। একজন ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তা বলেন, “ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে নিরাপত্তা ব্যাকস্টপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে, প্রথমে একটি সঠিক যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা বেশি জরুরি। যুদ্ধ শেষ করার রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর নির্ভর করবে বাহিনীর ধরন। এই বিনিময় নিয়ে আজ নেতারা আলোচনা করবেন।”
স্টারমারের কৌশল ও উপহার
স্টারমার, যিনি একজন প্রাক্তন মানবাধিকার আইনজীবী এবং লেবার পার্টির নেতা, ট্রাম্পের সঙ্গে এই সাক্ষাতে তাঁর মৃদু স্বভাবের বিপরীতে ট্রাম্পের উচ্চকিত ব্যক্তিত্বের মুখোমুখি হয়েছেন। তিনি নিজেকে ট্রাম্প এবং ইউরোপের মধ্যে “সেতু” হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ট্রাম্পকে খুশি করতে তিনি আরও একটি উপহার নিয়ে এসেছেন—যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির ঘোষণা। গত মঙ্গলবার তিনি বলেন, ২০২৭ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির ২.৫ শতাংশে উন্নীত হবে। ট্রাম্প প্রশাসনের এক কর্মকর্তা এতে “খুব খুশি” হয়েছেন বলে জানান।
ইউক্রেনের প্রতি ট্রাম্পের নীতি
ট্রাম্পের এই অবস্থান ইউক্রেনের জন্য উদ্বেগজনক। জেলেনস্কি বারবার বলেছেন, মার্কিন সমর্থন ছাড়া ইউক্রেন দীর্ঘমেয়াদে নিরাপদ থাকতে পারবে না। তিনি ন্যাটো সদস্যপদের দাবি জানিয়ে আসছেন, যা ট্রাম্প প্রত্যাখ্যান করেছেন। ট্রাম্প বলেন, “ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার কথা ভুলে যেতে পারে।” এই পরিস্থিতিতে স্টারমার এবং ইউরোপীয় নেতারা চাপে রয়েছেন। তারা চান না যে ট্রাম্প পুতিনের সঙ্গে এমন একটি চুক্তি করুন, যা ইউক্রেনের ভবিষ্যৎকে দুর্বল করে দেয়।
এই সাক্ষাতের পর স্টারমার এবং ট্রাম্প একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলন করবেন। ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ এবং ট্রাম্পের পুতিনের প্রতি আস্থা এই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে। ইউরোপ এবং ইউক্রেন এখন অপেক্ষায় আছে—ট্রাম্পের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?