এখন চলছে গরমকাল, আর তার সাথে চলে এসেছে বাংলার এক অতিপরিচিত এবং ভয়ংকর স্থানীয় ঝড়— কালবৈশাখী (Kalbaisakhi)। এই ঝড়টি মূলত গরমকালে দেখা দেয় এবং এটি এক ধরনের বজ্রঝড় যা পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। কালবৈশাখী, একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা প্রকৃতিতে অপ্রত্যাশিত আঘাত হানে এবং মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি সাধন করতে পারে।
কালবৈশাখী মূলত গরমকালে ছোটনাগপুর মালভূমির তপ্ত মাটির উপর তৈরি হয়। তীব্র গরমের কারণে উষ্ণ বাতাস পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং এতে ঝড় সৃষ্টি হয়, যা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই ঝড়ের প্রচণ্ড বাতাস এবং তীব্র বজ্রপাতের কারণে এটি মানবজীবনের জন্য অনেক বিপজ্জনক হতে পারে।
কালবৈশাখী কী?
কালবৈশাখী একটি শক্তিশালী বজ্রঝড় যা বিশেষভাবে বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড এবং প্রতিবেশী অঞ্চলে দেখা যায়। এটি সাধারণত দ্রুত গতিতে অগ্রসর হয় এবং ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার বা তার বেশি গতিতে পৌঁছাতে পারে। এর প্রভাবে বাতাসের গতিবেগও হঠাৎ ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বাড়তে পারে, যা অনেক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
কালবৈশাখীর প্রভাবে, বিশেষ করে গরমের সময়, তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে নেমে ২৫ থেকে ৩০ সেলসিয়াসে চলে আসে। এটি একদিকে যেমন তাপমাত্রা কমায়, তেমনই ফসলের ক্ষতি এবং মানুষের জীবনহানির কারণ হতে পারে। এই ঝড়ের সৃষ্টির ফলে অনেক সময় গাছপালা উপড়ে যায়, বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ভূমিধস ঘটতে পারে।
কালবৈশাখী এবং তার প্রভাব
কালবৈশাখীর প্রথম প্রভাব শুরু হয় মার্চ মাস থেকে এবং এর তীব্রতা সাধারণত বৈশাখ মাসে (মে মাস) সবচেয়ে বেশি থাকে। এই ঝড়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর অপ্রত্যাশিত আগমন এবং তার শক্তিশালী প্রবাহ। এপ্রিল মাসেও অনেক সময় এর প্রভাব দেখা যায়। এর পরবর্তীতে, বর্ষার মৌসুমে কালবৈশাখী আরও তীব্র হয়ে ওঠে এবং সাধারণত জুলাই-আগস্ট মাসে এটি আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। তবে, কখনো কখনো ফেব্রুয়ারী মাসেও এর দেখা মেলে।
একটি typical কালবৈশাখীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০০ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এটি ১ ঘণ্টা বা তারও কম সময়ে আঘাত করতে পারে, তবে এর সময়কাল অনেকটা পরিবর্তনশীল। কখনো কখনো এটি ঘণ্টার পর ঘণ্টা থাকতে পারে এবং কখনো তা কয়েক মিনিটেই সরে যায়। তবে, তার ফলস্বরূপ ক্ষতি একই রকম ব্যাপক হতে পারে।
কালবৈশাখী ঝড়ের বিস্তার
বিশেষজ্ঞদের মতে, কালবৈশাখী ঝড়ের বিস্তৃতি বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বিহার, ঝাড়খণ্ড, পূর্ব উত্তর প্রদেশ, পূর্ব মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, উত্তর অন্ধপ্রদেশ এবং পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলে প্রচুর হয়। এই ঝড়গুলো সাধারণত উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের দিকে চলে আসে, এবং কলকাতায় প্রায় ২২টি কালবৈশাখী ঝড় প্রতি বছর ঘটতে পারে। এর ফলে, কলকাতা এবং অন্যান্য শহরগুলোতে অনেক সময় প্রচণ্ড বৃষ্টি, বজ্রপাত এবং দমকা হাওয়া দেখতে পাওয়া যায়।
কলকাতায় কালবৈশাখী:
কলকাতায় কালবৈশাখী প্রবাহের কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই ঝড়ের কারণে গাছপালা উপড়ে যাওয়া, বাড়ির ছাদ উড়ে যাওয়া, বিদ্যুতের সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়া এবং বহু মানুষের আহত হওয়া সাধারণ ঘটনা হয়ে ওঠে। বিশেষত, কলকাতায় প্রতিটি বছর ২২টি কালবৈশাখী ঝড় দেখা যায় যা শহরের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। ঝড়ের পরে সড়কগুলোতে যান চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, যা শহরের নাগরিকদের জন্য দুর্ভোগের কারণ হয়।
কালবৈশাখী ঝড়ের প্রস্তুতি
কালবৈশাখীর আগমন নিশ্চিত হলে, কিছু প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। প্রথমত, বাড়ির জানালা এবং দরজাগুলো ভালোভাবে বন্ধ রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাড়ির আশেপাশের গাছপালা এবং উঁচু বস্তুগুলো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলুন। তৃতীয়ত, বৃষ্টির সময় খোলা মাঠে যেতে বিরত থাকুন এবং কোথাও আশ্রয় নিন। চরম ঝড়ের সময় কোনোভাবে বাইরে বের হওয়া উচিত নয়।
তাছাড়া, যদি কখনো এমন ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যায়, তাহলে স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে চলা উচিত। বৈদ্যুতিন মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকা আপডেটগুলো অনুসরণ করতে হবে। এতে আপনি সময়মতো সতর্ক হতে পারবেন।
কালবৈশাখী, বাংলার গরমকালীন স্থানীয় ঝড়, যে কোনও মুহূর্তে আপনার এলাকার ওপর আছড়ে পড়তে পারে। যদিও এটি মাঝে মাঝে তাপমাত্রা কমানোর কাজ করে, তবে এর সঙ্গে আসে ক্ষয়ক্ষতি এবং বিপদ। তাই, আজ থেকে কালবৈশাখী ঝড়ের জন্য সতর্ক থাকুন এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিন।