ইনিই হলেন ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি, চিনে নিন

ঘুম (Healthy Sleep) আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ভালো ঘুম না হলে শরীর এবং মন ঠিকমতো কাজ করতে পারে…

The Sleep Hormone Behind Restful Nights and Healthy Sleep Patterns

ঘুম (Healthy Sleep) আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ভালো ঘুম না হলে শরীর এবং মন ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। কিন্তু অনেকেই রাতে ঘুমাতে পারেন না বা ঘুমের মান কমে যায়, যার ফলে তাদের শরীর ও মনের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। আপনি জানেন কি, আমাদের ঘুমের পিছনে একটি বিশেষ রাসায়নিক উপাদান কাজ করে যা আমাদের ঘুমে সহায়তা করে? সেই রাসায়নিক উপাদানটির নাম মেলাটোনিন।

মেলাটোনিন: ঘুমের বন্ধু
মেলাটোনিনকে সাধারণত “ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসি” বলে আখ্যায়িত করা হয়, কারণ এটি আমাদের শরীরের ঘুম-জাগরণ চক্র নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এটি মূলত একটি নিউরোট্রান্সমিটার, যা আমাদের শরীরে ঘুম ও জাগরণের ছন্দকে সঠিকভাবে পরিচালিত করে। মেলাটোনিনের উৎপাদন প্রধানত আমাদের মস্তিষ্কের পাইনিয়াল গ্রন্থি থেকে হয় এবং এটি আমাদের শরীরকে ঘুমের জন্য প্রস্তুত করে।

   

মেলাটোনিন কিভাবে কাজ করে?
মেলাটোনিনের কাজ অনেকটা আমাদের শরীরের ঘড়ির মতো। দিনের বেলায় যখন আমরা সক্রিয় থাকি এবং পরিবেশে প্রচুর আলো থাকে, তখন মেলাটোনিনের উৎপাদন কমে যায়। এর ফলে আমাদের শরীর জেগে থাকে এবং আমরা সচেতন থাকি। তবে, যখন রাতের সময় বা অন্ধকার পরিবেশে আলো কমে যায়, তখন মেলাটোনিনের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, ফলে শরীরকে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত করে। এটাই মূল কারণ, রাতে ঘুম ভালো হয় এবং দিনের আলোতে আমরা সচেতন এবং সক্রিয় থাকি।

অতএব, মেলাটোনিন আমাদের শরীরের একটি স্বাভাবিক ঘুমের চক্র বজায় রাখতে সাহায্য করে, যা ঘুমের জন্য অপরিহার্য। বিশেষত, রাতের সময় যখন আমাদের শরীরে পর্যাপ্ত অন্ধকার থাকে, তখন মেলাটোনিন শরীরে প্রবাহিত হয়ে আমাদের ঘুমের জন্য প্রস্তুত করে।

মেলাটোনিনের অভাব এবং ঘুমের সমস্যা
বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির বিকাশের সাথে অনেকের ঘুমের সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, টিভির স্ক্রিনের নীল আলো আমাদের ঘুমের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। এই নীল আলো মেলাটোনিন উৎপাদনের জন্য বাধা সৃষ্টি করে, যার ফলে আমাদের ঘুমে সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে রাতে, যখন আমরা মোবাইল বা ল্যাপটপ ব্যবহার করি, তখন আমাদের শরীরের মেলাটোনিন উৎপাদন কমে যায় এবং ঘুমে বিঘ্ন ঘটে।

তবে, এই সমস্যা প্রতিরোধের জন্য কিছু সহজ উপায় রয়েছে। প্রথমত, ঘুমানোর আগে ফোন, কম্পিউটার বা টিভি ব্যবহার কমানো উচিত। এমনকি, বর্তমানে অনেক ফোনের মধ্যে ‘নাইট মোড’ বা ‘ডুম লাইট’ ফিচার থাকে, যা স্ক্রিনের নীল আলো কমিয়ে দেয় এবং মেলাটোনিন উৎপাদন বজায় রাখতে সহায়ক হয়।

ঘুমের জন্য কিছু টিপস
১. নিয়মিত ঘুমানোর সময় নির্ধারণ করুন
একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করুন। এটি আপনার শরীরের বায়োলজিক্যাল ক্লককে সঠিকভাবে কাজ করতে সহায়তা করবে এবং ঘুমের গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে।

২. মোবাইল ফোন এবং টিভি কম ব্যবহার করুন
রাতের বেলা ঘুমানোর আগে মোবাইল ফোন বা টিভির ব্যবহার কমিয়ে দিন। স্ক্রিনের নীল আলো মেলাটোনিন উৎপাদনকে ব্যাহত করে, যা ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি করে।

৩. অন্ধকার পরিবেশে ঘুমান
অন্ধকার ঘর বা রাতে ঘুমানোর জন্য ভালো পরিবেশ তৈরি করুন। ঘরের আলো কমিয়ে দিলে মেলাটোনিন উৎপাদন বাড়ে এবং ঘুম ভালো হয়।

৪. ব্যায়াম করুন
দিনের বেলায় একটু শারীরিক পরিশ্রম করলে রাতে ঘুমের মান অনেক বাড়ে। তবে, ঘুমানোর এক থেকে দুই ঘণ্টা আগে কোনো ভারী শারীরিক পরিশ্রম করবেন না।

৫. তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করুন
ঘর বা শয়নকক্ষের তাপমাত্রা যেন খুব গরম বা ঠাণ্ডা না হয়, তা নিশ্চিত করুন। আদর্শ তাপমাত্রায় ঘুমানোর জন্য শরীরের ভিতরও পর্যাপ্ত মেলাটোনিন উৎপাদিত হয়।

মেলাটোনিন ও স্বাস্থ্য
ঘুমের গুণগত মান আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। দীর্ঘ সময় ধরে ভালো ঘুমের অভাব হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রেস, উদ্বেগ, এমনকি ডিপ্রেশনের মত সমস্যাও তৈরি করতে পারে। মেলাটোনিন ঠিকমতো কাজ করলে, তা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে, মনোযোগ এবং মেমোরি উন্নত করে এবং দেহের শক্তি পুনরুদ্ধারে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

মেলাটোনিনের সাপ্লিমেন্ট
যারা স্বাভাবিকভাবে মেলাটোনিন উৎপাদনে সমস্যা অনুভব করেন, তাদের জন্য বাজারে মেলাটোনিন সাপ্লিমেন্টও পাওয়া যায়। তবে, এসব সাপ্লিমেন্ট ব্যবহারের আগে একজন ডাক্তার বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। বিশেষ করে, যারা দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন, তাদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

মেলাটোনিন আমাদের শরীরের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উপাদান, যা আমাদের ঘুম ও জাগরণের ছন্দ নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমান যুগে প্রযুক্তির প্রভাবে এই প্রক্রিয়া কিছুটা বিঘ্নিত হলেও, সচেতনতা ও কিছু সতর্কতার মাধ্যমে আমরা সহজেই আমাদের ঘুমের চক্রকে সঠিকভাবে পুনরুদ্ধার করতে পারি। নিয়মিত ভালো ঘুম আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করবে, এবং আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং, মেলাটোনিনের গুরুত্ব বুঝে, আমাদের ঘুমের অভ্যাস উন্নত করা উচিত।