কলকাতা শহরের মাটির পরিস্থিতি (Soil Erosion) দিন দিন আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, আর এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী ‘কালীঘাট ফর্মেশন’ (Soil Erosion) নামে পরিচিত মাটি। ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, কলকাতা এবং হাওড়ার ভূগর্ভস্থ জলস্তর ক্রমশ নিচে নেমে যাওয়ার ফলে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, যার প্রভাব বহুতলগুলির নিরাপত্তায় পড়ছে। একের পর এক বহুতল হেলে পড়ছে, যার পেছনে রয়েছে কলকাতার মাটির ভঙ্গুর প্রকৃতি।
ভূবিজ্ঞানী সুজীব কর জানাচ্ছেন, কলকাতার মাটির উপরের স্তর ভাল হলেও তার নিচের স্তরের অবস্থা বিপজ্জনক। ‘কালীঘাট ফর্মেশন’ (Soil Erosion) নামে পরিচিত মাটি আঠালো ও থকথকে, কিন্তু ঠিক এর নিচের স্তর ভঙ্গুর এবং ঝুরঝুরে। এর ফলে মাটির স্তরেও বিভিন্ন পরিবর্তন আসছে, যার প্রভাব শহরের উপরিভাগের নির্মাণ কাজগুলোতে পড়ছে।
কালীঘাট ফর্মেশন সম্পর্কে সুজীব কর জানান, হাজার বছরের পুরনো এক দ্বীপ থেকে পলি জমার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে কলকাতা, হাওড়া, হুগলি ও দুই ২৪ পরগনার মাটির উপরের স্তর তৈরি হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই মাটির নিচের স্তর দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, আর এর ফলেই কলকাতার বহু বহুতল হেলে পড়ছে।
বিভিন্ন গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলস্তর নিম্নমুখী হওয়ার কারণে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। শহরের মাটির তলা থেকে প্রতি দিন যেভাবে জল তোলা হচ্ছে, তার তুলনায় ভূগর্ভে জল ফিরিয়ে নেওয়ার পরিমাণ খুবই কম। ফলে মাটি শুকিয়ে যাচ্ছে এবং কালীঘাট ফর্মেশনের নিচের স্তর আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে।
এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে যখন শুষ্ক ভূগর্ভ আশপাশের আর্দ্র অঞ্চলের জল টানতে শুরু করে, যার ফলে মাটির তলায় জল প্রবাহের জন্য কোনাকুনি চ্যানেল তৈরি হচ্ছে। এই চ্যানেলগুলির মাধ্যমে মাটির নীচে ফাঁপা জায়গা তৈরি হচ্ছে, যা বহুতল ভবনের স্থিতিশীলতায় বিপদ সৃষ্টি করছে।
বিভিন্ন ভূবিজ্ঞানীরা বলেছেন, গঙ্গা এবং বাগজোলা খালে পলি জমার ফলে এই সমস্যা আরও প্রকট হয়ে উঠছে। ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে গঙ্গার পলি স্তরের বৃদ্ধি এর প্রকৃত প্রমাণ। গঙ্গার বুকে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি পলি জমেছে, যা কলকাতা এবং হাওড়ার মাটির তলা থেকে বেরিয়ে গঙ্গার দিকে চলে যাচ্ছে।
এছাড়া, শহরের বিভিন্ন অংশ যেমন বাবুঘাট, বড়বাজার, শোভাবাজার, কাশীপুর, দক্ষিণেশ্বর থেকে গার্ডেনরিচ, মানিকতলা, বিধাননগর পর্যন্ত এলাকায় মাটির তলায় বিপদ বাড়ছে। একই পরিস্থিতি রয়েছে নবান্ন, কোনা এক্সপ্রেসওয়ে এবং ডোমজুড় এলাকার মাটির নিচে।
নির্মাণ বিশেষজ্ঞ পার্থপ্রতিম বিশ্বাস বলেন, কলকাতা শহরের মাটির উপরের স্তরের চরিত্র পরীক্ষা করার পাশাপাশি, মাটির ধারণক্ষমতাও মূল্যায়ন করা জরুরি। শহরে কতটা চাপ নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে, তা হিসাব করে নির্মাণ কাজ শুরু করা উচিত।
এদিকে, ভূবিজ্ঞানী পৃথ্বীশকুমার রায় জানান, ভূগর্ভস্থ জলস্তরের পুনরুদ্ধারের জন্য ডায়রেক্ট রিচার্জ বাড়ানোর ব্যবস্থা করা উচিত। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, প্রতিটি বহুতলকে বাধ্য করতে হবে, তাদের ব্যবহৃত জল নর্দমায় না পাঠিয়ে মাটির তলায় পাঠানোর ব্যবস্থা করতে। এছাড়া, কংক্রিটের আচ্ছাদন কমিয়ে খোলা জায়গা রাখতে হবে, যাতে জল মাটিতে সরাসরি প্রবাহিত হতে পারে।
এই পদক্ষেপগুলি কার্যকর হলে কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলস্তর পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে এবং ভবিষ্যতে শহরের মাটির অবস্থা আরও স্থিতিশীল হবে।