মুজিব হত্যা ষড়যন্ত্র-৫: সেই রজনীগন্ধা বাসর! মেজর ডালিমের কলকাতা কানেকশন

কেন মুজিবুর রহমান খুন? Kolkata 24×7 প্রকাশ করছে সিরিজ। এই সিরিজের মূল লক্ষ্য, মুজিব হত্যার নেপথ্য অংশগুলি দেখা। (The story behind the assassination of Sheikh…

story behind the assassination of Sheikh Mujibur Rahman

কেন মুজিবুর রহমান খুন? Kolkata 24×7 প্রকাশ করছে সিরিজ। এই সিরিজের মূল লক্ষ্য, মুজিব হত্যার নেপথ্য অংশগুলি দেখা। (The story behind the assassination of Sheikh Mujibur Rahman)

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: ঢাকার সদরঘাট। বিরাট বিরাট স্টিমারগুলো দুলছে। ভেঁপু বাজছে। জল মাপছে সারেং। যাত্রীদের ভিড়ে বিক্রি হচ্ছে গরম নেহারি, ডিম, পরোটা হরেক লোভনীয় খাবার। দূরপাল্লার যাত্রীদের নিয়ে ভোরে স্টিমার ছাড়বে- বরিশাল, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর…বুড়িগঙ্গায় ঢেউ তুলে ভোঁ বাজিয়ে স্টিমারের গন্তব্য আরও দূরে- আরও দূরে। পদ্মা মেঘনা শীতলক্ষার তীরের দূরবর্তী জনপদের সঙ্গে মহানগরী ঢাকার বেশি যোগাযোগ নৌপথে। সদরঘাটের ব্যস্ততা সর্বদা তুঙ্গে। সে রাতে যখন ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাঙ্ক বাহিনী বের হয়ে ঘড় ঘড় করে রাজপথে চলছিল তখনও সদরঘাটে টিকিট নিয়ে চলছে হৈচৈ ঠেলাঠেলি গালাগালি।

   

রাত শেষে বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল গম্ভীর স্বরে বেতার বার্তা ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। কারফিউ জারি করা হয়েছে। ’ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোর। সদরঘাটের যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ রেডিও খুলেছিলেন। কে কী শুনলেন তার ঠিক নেই শুরু হয়ে গেল হুড়োহুড়ি। ততক্ষণে সেনাবাহিনীর ভ্যানগুলো পরপর এসে থামছে। বন্দুক উঁচিয়ে ঢুকছে রক্ষীরা। বুড়িগঙ্গায় নাচতে থাকা ঢেউয়ের মতো ভয় ছড়িয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙা বাংলাদেশ জানল শেখ সাহেবকে খুন করা হয়েছে।

সে রাতেই ঘটেছিল বাংলাদেশের প্রথম সেনা অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনাকারী মেজর শরিফুল হক ডালিম। তিনি মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করার কারণ হিসেবে দাবি করেন, স্বাধীনোত্তর বাংলাদেশে স্বৈরাচার ও স্বজনপোষণ শুরু হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন পদ্ধতি অনেক সেনা অফিসার মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি লিখেছেন- বাংলাদেশ নামে একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল। কিন্তু শাসক বুর্জুয়াদের মধ্যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটল না। তাদের চরিত্রে রয়ে গেল মুৎসুদ্দী ধামাধরার প্রবণতা। আমেরিকা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। কোন অবস্থাতেই ভবিষ্যতে মার্কিন সাহায্য বাংলাদেশ গ্রহণ করবে না এই সাহসী সরকারি ঘোষণা মুজিবনগরে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে তার প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনেই বলতে বাধ্য হলেন যে তিনি মার্কিন সাহায্য গ্রহণ করবেন। (বানান অপরিবর্তিত)

‘মুজিব হত্যা’র সাফাই দিতে গিয়ে মেজর ডালিম লিখেছেন ‘মুজিবনগর’। এতে মিশে আছে পাকিস্তান কেটে বাংলাদেশ তৈরির সময় অর্থাৎ ১৯৭১ সালে তৈরি হওয়া প্রবাসী সরকারের কথা। কূটনৈতিক জটিলতা এড়িয়ে ভারত থেকে পরিচালিত হতো ‘মুজিবনগর সরকার’ বকলমে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। সদর দফতর কলকাতা। সেই সূত্রে কলকাতায় আগমন শরিফুল হক ডালিমের।

কলকাতায় ডালিম !
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত শরিফুল হক ডালিম ১৯৭১ সালে গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে আসেন। এরপর তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। কলকাতায় তখন চলছে মুজিবনগর সরকার। সেই সরকারের অধীন গেরিলা বাহিনী (মুক্তি বাহিনী) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চারপাশ থেকে ১১টি সেক্টর তৈরি করে আক্রমণ শুরু করেছিল। ডালিম ছিলেন এক নম্বর সেক্টরের এক কমান্ডার। যুদ্ধকালীন সময়ে গুলি লেগে তার হাত জখম হয়। তিনি কলকাতায় এসে গুলিবিদ্ধ হাতের চিকিৎসা করান। সেই সময়েই তার জীবন মোড় নিল। তার বীরত্বে মুগ্ধ পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা যুদ্ধ-শরণার্থী উচ্চবিত্ত পরিবারের রূপবতী নিম্মী।

কলকাতায় লুকিয়ে আছে মুজিব হত্যায় জড়িত ডালিমের অন্য জীবন!
মেজর ডালিমের বয়ানে কিছু অংশ- “যুদ্ধকালীন সময়ে কোলকাতায় বেশকিছু পরিবারের সাথে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। তাদের মধ্যে মিত্রী মাসী, ডঃ গনী এবং তার পরিবার, অরূপ দা ও পারুমিতা বৌদি, জনাব আইয়ূব ও তার স্ত্রী গৌরিদী, প্রিতিশ নন্দী ও তার স্ত্রী রীনা, ইন্দু প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অসীম ভালোবাসা ও সহানুভূতি পেয়েছিলাম। তারা সবাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিভিন্নভাবে প্রচুর অবদান রেখেছিলেন। যুদ্ধের বিবরণ ও অগ্রগতি সম্পর্কে আমাদের কাছ থেকে শুনতে তারা সর্বদাই বিশেষভাবে উদগ্রীব হয়ে থাকতেন।” (বানান অপরিবর্তিত)

শরিফুল হক ডালিম লিখেছেন- থিয়েটার রোডেই আমার থাকার ব্যবস্থা হল। তখনকার দিনে প্রখ্যাত বোন স্পেশালিষ্ট ডঃ মুরালী মুখার্জীর সাথে আমার চিকিৎসার ব্যাপারে পারুমিতা বৌদি ইতিমধ্যেই আলাপ করেছেন। আমার ক্ষত পরীক্ষা করে তিনি বললেন, “গান পাউডার এবং বুলেট ইনজ্যুরির ফলে খারাপ ধরণের ইনফেকশন দেখা দিয়েছে। ইনফেকশনটাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে গ্যাংরিনে টার্ন নিতে পারে। প্রথমে চেষ্টা করতে হবে ইনফেকশন বন্ধ করার।” ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু কিছুই করার নেই। বাস্তবতাকে মেনে নিতেই হবে। তিনি ঔষধ, ইনজেকশন লিখে দিলেন এক সপ্তাহের জন্য। বৌদি আমাকে মনোবল জোগানোর জন্য বললেন, “কোন চিন্তা করবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।” বেশিরভাগ সময় আমাকে শুয়েই থাকতে হয়। বাপ্পির সাথে নিম্নী এসে আমাকে দেখে গেছে। রোজ তার পক্ষে আসা সম্ভব নয়। সুযোগমত ও টেলিফোন করে আমাকে। বাপ্পির মাধ্যমে ভালোমন্দ খাবার পাঠায় প্রায়ই। (বানান অপরিবর্তিত)

নিম্মীর পূর্বরাগ ক্রমে গভীর প্রেমে পরিণত হয়। আত্মীয়দের অমতে সে গোপনে শরিফুল হক ডালিমকে বিয়ে করে। মেজর ডালিম লিখেছেন, “বিয়ের দলিল রেজিষ্ট্রি করতে দু-তিন দিন সময় লাগবে। এ সময়টা লুকিয়ে থাকতে হবে আমাদের। কারণ নিম্মীর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে বিয়ে করার পরিপ্রেক্ষিতে যে অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে তার মোকাবেলা করার জন্য বিয়ের দলিলটা অপরিহার্য। গৌরিদীই ঠিক করে ফেললেন তার পরিচিত এক ধনী ব্যবসায়ীর পার্ক ষ্টিট্রের একটা গেষ্ট হাউস। ছোট্ট কিন্তু সাজানো গেষ্ট হাউস। সেখানেই হবে আমাদের বাসর এবং মধুচন্দ্রিমা। আমাদের গোপন আস্তানার খবর বিয়েতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিবর্গ ছাড়া আর কাউকে জানানো হবে না। সেদিন সন্ধ্যায় আমাদের চলে যেতে হল গেষ্ট হাউসে। নায়লা, গৌরিদী, নূর এবং সালাহউদ্দিন আমাদের পৌঁছে দিল। রজনীগন্ধা ও বেলী ফুল দিয়ে নায়লা, লুবনারা সুন্দর করে রুচিসম্মতভাবে সাজিয়ে দিয়েছিল আমাদের বাসর ঘর। ওরা চলে যাবার পর হঠাৎ করে আমরা দু’জন ভীষণ একলা হয়ে গেলাম। সারাদিনের ঘটনাবলী এত দ্রুত ঘটেছে যার ফলে চিন্তা-ভাবনার কোন অবকাশই আমরা পাইনি এতক্ষণ। একটা ঘোরের মাঝেই কেটে গেছে পুরো দিনটা। ফ্ল্যাটের নির্জন পরিবেশে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রবাহের গুরুত্ব উপলদ্ধি করে কেঁদে উঠল নিম্নী।” (ক্রমশ)

গত পর্ব: মুজিব হত্যা ষড়যন্ত্র-৪