গীতাপাঠের আগে ফুটবল খেলা জরুরি, কেন বলেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ?

স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) ছিলেন এক মহান মনীষী, যাঁর জীবন ও চিন্তাধারা আজও আমাদের পথপ্রদর্শক। তাঁর দর্শন শুধু ভারতীয় সমাজের জন্য নয়, সমগ্র মানবতার জন্য…

Swami Vivekananda's Views on Geetapath and Football: The Importance of Physical Strength and Spirituality

স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) ছিলেন এক মহান মনীষী, যাঁর জীবন ও চিন্তাধারা আজও আমাদের পথপ্রদর্শক। তাঁর দর্শন শুধু ভারতীয় সমাজের জন্য নয়, সমগ্র মানবতার জন্য এক অমূল্য দান। তবুও, মাঝে মাঝে তাঁর কিছু বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা ও অপব্যাখ্যা হয়, যার মধ্যে অন্যতম হলো ফুটবল খেলা এবং গীতাপাঠ নিয়ে তাঁর মন্তব্য। এই বিষয়ে তিনি ঠিক কী বলেছিলেন, তা আমাদের জানা প্রয়োজন।

১৮৯৭ সালে, স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) মৃত্যুর মাত্র কয়েক বছর আগে মাদ্রাজ (আজকের চেন্নাই) সফরে যান। সেখানে তিনি ‘ভারতীয় জীবনে বেদান্তের প্রয়োগ’ শীর্ষক একটি বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতায় তিনি ফুটবল খেলা এবং গীতাপাঠ প্রসঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। তিনি বলেন, “আমরা দুর্বল, অতি দুর্বল। প্রথমত আমাদের শারীরিক দৌর্বল্য—এই শারীরিক দৌর্বল্য আমাদের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ দুঃখের কারণ।” এর পর তিনি আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন, “আমাদের যুবকগণকে প্রথমত সবল হইতে হইবে, ধর্ম পরে আসিবে। হে আমার যুবক বন্ধুগণ, তোমরা সবল হও – তোমাদের নিকট ইহাই আমার বক্তব্য। গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে।”

   

এখানে তিনি যে বার্তা দিয়েছেন, তা হল শারীরিক শক্তির গুরুত্ব। তিনি জানতেন, যুব সমাজের মধ্যে শারীরিক এবং মানসিক শক্তির উন্নয়ন অপরিহার্য। এক শক্তিশালী শরীরই মানুষের মানসিক শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি তৈরি করে। তাঁর বক্তব্য ছিল, যদি যুবকরা শারীরিকভাবে মজবুত না হয়, তবে তারা কোনো কিছুতেই সফল হতে পারবে না। ফুটবল খেলার মাধ্যমে শরীরকে শক্তিশালী করা, এর মাধ্যমে একধরনের অনুশীলন এবং আত্মবিশ্বাস তৈরি করা সম্ভব।

তাঁর এই বক্তব্যের উদ্দেশ্য ছিল, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা বা গীতাপাঠ প্রথমে নয়, আগে শরীরকে শক্তিশালী করতে হবে। শক্তিশালী শরীরের মাধ্যমে মানুষ যে কোনো কাজে সফল হতে পারে এবং পরবর্তীতে সেই শক্তিকে আত্মিক উন্নতির জন্য ব্যবহার করতে পারে। তিনি আরো বলেন, “শরীর শক্ত হলে তোমরা গীতা আরও ভালো বুঝবে। তোমাদের রক্ত তাজা হলে শ্রীকৃষ্ণের মহতী প্রতিভা ও মহান বীর্য বুঝতে পারবে।”

তবে, অনেক সময় এই বক্তব্যের খণ্ডিত অংশ তুলে ধরে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়। অনেকেই মনে করেন, তিনি গীতাপাঠের তুলনায় ফুটবল খেলার গুরুত্ব বেশি বলেছেন। কিন্তু আসলে তিনি বলছিলেন যে, শারীরিক শক্তির ভিত্তি গড়ে উঠলেই ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা ভালোভাবে অনুধাবন করা সম্ভব। এই বক্তব্যে তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, প্রথমে শরীরকে শক্তিশালী করতে হবে, তারপরই আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ অনুসরণ করা যাবে। তিনি ‘উপনিষদ’ থেকে উদ্ধৃত একটি শ্লোকের উল্লেখ করে এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে বলা হয়েছে, “নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য” — অর্থাৎ, “বলহীনের দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ হয় না।”

স্বামী বিবেকানন্দের এই বক্তব্য আমাদের শিক্ষা দেয় যে, শারীরিক ও মানসিক শক্তি একে অপরের পরিপূরক। একজন মানুষের শারীরিক স্বাস্থ্য যত শক্তিশালী হবে, ততই তার আধ্যাত্মিকতা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকবে। তাই, তাঁর এই বাণীকে যদি সঠিকভাবে বুঝতে পারি, তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবে বলব যে, শারীরিক শক্তি এবং আধ্যাত্মিকতার মধ্যে এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

স্বামী বিবেকানন্দের এই বাণী আজও আমাদের পথ দেখায়। তাঁর বাণী শুধু তখনকার সময়ে নয়, বর্তমান সময়েও আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক। যতটা গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক শক্তি, ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক শক্তি। এই দুটি মিলে গড়ে তোলে একটি সুস্থ, সক্ষম এবং উন্নত সমাজ।