IISCO modernization victory day
প্রসেনজিৎ চৌধুরী, বর্ধমান: একুশ শতকের শুরুতে যখন বর্ধমান নামে কোনও এক জেলার অস্তিত্ব ছিল সেই সময়ের কথা-সে দিন সকাল থেকে দামোদরের তীরে আনন্দ। হাজার হাজার শ্রমিকের হাসি হাসি মুখ দেখা যাচ্ছে। রূপার নুপূর ঝমরিয়ে হাঁটা শ্রমিক নারীর নাকফুলের হাসি ঝিকমিক করছে। কোলে বাচ্চা। এদেরই কেউ বিড়িতে টান দিয়ে হনহনিয়ে চলেছে। শ্রমিক মরদের কারোর চোখ নেশায় ঢুলুঢুলু। কেউ বেলচা কাঁধে মিছিলে গলা ফাটাচ্ছে। বালির চরায় ঝিকঝিক করা দামোদরের জলের ফালিতে এদের ছায়া পড়ছিল। আজ উৎসবের দিন। নতুন করে বার্নপুরের কারখানা সেজে উঠেছে।
‘ইস্কো বাঁচাও’ আন্দোলনের বিজয় দিবস IISCO modernization victory day
সেদিন ছিল ইস্কো (IISCO) ইস্পাত কারখানা আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণের দিন। দু’দশক আগে ২০০৬ সালে এমনই এক উৎসব দেখেছিলাম বার্নপুরে। বিশ্বের অন্যতম শিল্পনগরীর জনজীবনে স্বস্তির শ্বাস পড়ছিল। রোজগারের নিশ্চিত স্বস্তি-স্বপ্ন। সেই উৎসব মুহূর্তের ঐতিহাসিক তারিখ ২৪ ডিসেম্বর। শ্রমিকদের গরম নিঃশ্বাসে দামোদরের এলেবেলে হাওয়ায় উড়ে আসা বড়দিনের শীত থমকে গেছিল। সে এক মহাযজ্ঞ! দশকের পর দশক চলা “ইস্কো বাঁচাও” আন্দোলনের বিজয় দিবস।
বাম খাঁচায় বন্দি মনমোহন সিং IISCO modernization victory day
কেন্দ্রে তখন ইউপিএ জোট সরকারের মূল নিয়ন্ত্রক সিপিআইএম ও অন্যান্য বাম দল। দেশে বামপন্থীরা সরকার গড়তে পারেনি। তবে ইউপিএ জোটে তারাই ছিল মূল খুঁটি। সেই সরকারে কংগ্রেসের উদার বেসরকারিকরণ অর্থনীতির বিরোধী অবস্থানে থেকেও বাম রক্ষণশীল অর্থনীতির মধুচন্দ্রিমা চলছিল। এমনধারা রাজনৈতিক প্রেম এ দেশে আগে দেখা যায়নি। বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে প্রশ্ন উঠছে “আরে হচ্ছেটা কী ভারতে!” সেই অভূতপূর্ব কংগ্রেস-বাম জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অর্থনীতির বিশারদ ড. মনমোহন সিং। তিনি বাজারমুখী অর্থনীতির গবেষক হলেও পড়ে গিয়েছিলেন রক্ষণশীল বাম অর্থনীতির পুকুরে। মনমোহিনী ভাষণে তীব্র বাজারমুখী নীতির ইঙ্গিত পেলেই সরকার ফেলার হুমকি দিতেন আরও এক সিং সাহেব। এই হুমকি আসত মনমোহনের স্বগোত্রীয় হরকিষেন সিং সুরজিতের কাছ থেকে। সিপিআইএমের শীর্ষ নেতার মিটিমিটি হাসির মধ্যে এরকমই হরেক রাজনৈতিক রোমাঞ্চ কাহিনী লুকিয়ে গেছে চিরতরে।
তখনও বর্ধমান জেলা IISCO modernization victory day
তখনও রাঢ়ের রুক্ষু মাটিতে ধুলোমাখা লোকশিল্পীর কণ্ঠে ভেসে আসত “এমন জেলা কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…” ! বাস্তবিক, তখন অবিভক্ত বর্ধমান দেশের এমন এক জেলা, যেখানে কৃষি উৎপাদন, খনিজ সম্পদ ও বিশ্বে আলোচিত কলকারখানার সহাবস্থান। ২০১৭ সাল থেকে এই তকমা দ্বিখণ্ডিত। বর্ধমান জেলা অবলুপ্ত। এখন পূর্ব বর্ধমান কৃষিজ অঞ্চল। আর পশ্চিম বর্ধমানে খনি-শিল্প কেন্দ্র।
সেই ইস্কো উৎসবের দিনে! IISCO modernization victory day
যাইহোক ফিরি দামোদর তীরে সেই শিল্প উৎসবের দিনে সেই বর্ধমান জেলায়। রাজ্যব্যাপী প্রচারিত সংবাদপত্রের সংবাদদাতা হিসেবে বার্নপুর গেছিলাম। মূল ম্যাড়মেড়ে অনুষ্ঠানে আগ্রহ ছিল না। খোলা রাস্তা, মাঠে দেখছিলাম জনতার সারি। মাইকে ইংরাজিতে মনমোহন সিংয়ের ভাষণ শোনার লোক কম। কারখানা নতুন করে প্রাণ পাচ্ছে এতেই খুশি শ্রমিক-জনতা। লাল, সবুজ, নীল তথা বাম-ডান ভিন্ন ভিন্ন র়ঙের শ্রমিক সংগঠনের সারিতে থাকা শ্রমিকদের মুখগুলো বলে দিচ্ছিল আজ যুদ্ধ জয়ের দিন।
ইস্কো বাঁচাও আন্দোলন IISCO modernization victory day
ইস্কো কারখানা স্থাপন দেশের অর্থনীতির ইতিহাসে একটি মাইলফলক। ১৯১৮ সালে শিল্পপতি স্যার রাজেন মুখার্জি ও ব্রিটিশ মার্টিন বার্ন সংস্থার যৌথ উদ্যোগে বার্নপুরে শিল্প প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পরে তার দায়িত্ব নিয়েছিলেন স্যার বীরেন মুখার্জি। ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি লিমিটেড (ইস্কো) গড়ে উঠেছিল। স্বাধীনতার পর কংগ্রেস জমানায় ইস্কো হয় রাষ্ট্রায়ত্ব সম্পত্তি। কৌলিন্য থাকলেও রুগ্ন হয়ে পড়ছিল ইস্কো। শুরু হয়েছিল ‘ইস্কো বাঁচাও আন্দোলন’। তিন দশকের বেশি সময় ধরে চলা এই আন্দোলনের প্রধান দুই শ্রমিক সংগঠন আইএনটিউসি (কংগ্রেস) এবং সিআইটিউ (সিপিআইএম)। রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার থাকায় ইস্কো রক্ষা করতে বাম শ্রমিক সংগঠন সিআইটিউ ছিল মূখ্য ভূমিকায়।
রুগ্ল ইস্কো কারখানার উন্নয়নে আন্দোলন শুরু হয়েছিল আশির দশকে। পাঁচটি কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন ও অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের যৌথ মঞ্চ ‘ইস্কো বাঁচাও কমিটি’-এর আহ্বায়ক ছিলেন বাম শ্রমিক নেতা চন্দ্রশেখর মুখার্জি। ২০০৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইস্কো আধুনিকরণ-সম্প্রসারণ ঘোষণার দিন বার্নপুরে আসা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের অনুষ্ঠানে যখন চলছে তখন ইস্কো আন্দোলনের সেনাপতি চন্দ্রশেখর মুখার্জি শয্যাশায়ী। তিনি কাঁপাকাঁপা হাতে আমন্ত্রণপত্র গ্রহণ করেছিলেন।
সেই উৎসবের শেষে IISCO modernization victory day
অনুষ্ঠান শেষে মনমোহন সিং ফিরে গেছেন। চলে গেছেন প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সাংসদ বংশোগোপাল চৌধুরীসহ অতিথিরা। বাঙালি শিল্পপতি স্যার বীরেন মুখার্জির বিখ্যাত চাটার্ড বিমানের পাশ দিয়ে হাসি হাসি মুখে ধুলো উড়িয়ে ফিরে চলেছে শ্রমিক-জনতার ঢল। আমার সহযাত্রী আরও দুই বরিষ্ঠ সাংবাদিকের সঙ্গে ফিরছি। হঠাৎ দেখা ‘কয়লা মাফিয়া’ বলে চর্চিত কালে সিংয়ের সঙ্গে। তার মুখেও মুচকি হাসি। খানিক গল্পগাছায় কালে সিং হিসেব কষে সটান বলে দিল এবার তার লেনদেন কত বাড়বে। এও এক দৃশ্য। যে যার মতো সবাই খুশি!
মনমোহিনী দিনটা এরকমই ছিল।
Bharat: The modernization of the IISCO steel plant in Burnpur marked a significant victory for the “Save IISCO” movement. Celebrated on December 24, 2006, this event brought relief and hope to thousands of workers and the industrial city.