কলকাতার হলুদ ট্যাক্সি (yellow taxis) পরিষেবা শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে পরিচিত। এর দীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং শহরের পরিসরে এটি একধরনের চিহ্ন হয়ে উঠেছে। তবে, আধুনিক প্রযুক্তি এবং পরিবহণের নতুন ধরনের পরিবর্তনশীল পদ্ধতিতে যখন শহরে অ্যাপ-ক্যাব ও অন্যান্য সেবা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তখন হলুদ ট্যাক্সি (yellow taxis) পরিষেবার জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারা, সরকারি নিয়মের কঠোরতা, এবং ট্যাক্সি চালকদের কম আয় – এসবই বর্তমান পরিস্থিতির অন্যতম কারণ।
দিনে নয়, রাতের কাজেই চলছে ট্যাক্সি:
প্রধানত দিন থেকে রাতের মধ্যে চরম পরিবর্তন ঘটে হলুদ ট্যাক্সির পরিষেবা ব্যবস্থায়। দুপুরের বেলা শহরের রাস্তায় ট্যাক্সির সংখ্যা যথেষ্ট কম থাকে, কিন্তু রাতের দিকে বাসের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ট্যাক্সির সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো, যেমন এসপ্লানেড, হাওড়া স্টেশন, খিদিরপুর এবং অন্যান্য এলাকায় এই শাটল ট্যাক্সির সংখ্যা বেড়ে যায়। দিনে যখন যানজট বেশি থাকে, তখন ট্যাক্সির কাজ কঠিন হয়ে পড়ে এবং আয়ের পরিমাণও কমে আসে। তবে, রাতের দিকে বাঁধা খদ্দেররা তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য এই শাটল ট্যাক্সি পরিষেবাকে আরও বেশি ব্যবহার করেন, কারণ সন্ধ্যা বা রাতের সময়ে বাসের সংখ্যা কমে যায় এবং ওই সময়টাই ট্যাক্সিচালকদের জন্য বেশি লাভজনক হয়ে ওঠে।
বৈধতা ছাড়া কাজ করা:
এছাড়া, একটি বড় সমস্যা হচ্ছে কিছু ট্যাক্সি চালক যারা বৈধ নথিপত্র ছাড়াই শহরের বিভিন্ন পথে ট্যাক্সি চালান। সন্ধ্যার পর শহরের পানশালা বা রেল স্টেশনগুলোর আশপাশে এই ধরনের চালকদের দেখা যায় যারা মাসিক চুক্তির ভিত্তিতে নির্দিষ্ট যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন। বিশেষত, বেশ কিছু সঙ্গীত শিল্পী যারা রাতে পানশালায় কাজ করেন, তারা এ ধরনের চালকদের ট্যাক্সি ব্যবহার করেন এবং শহরের বাইরে থেকে আসা অনেক সাধারণ যাত্রীও এই ট্যাক্সি সিস্টেমে ভরসা রাখেন।
এছাড়া, সন্ধ্যার পর শহরের বাজারগুলোতে আনাজ বা মাছ পরিবহণের জন্য কিছু ট্যাক্সি শহরতলির দিকে চলে যায়। ভোর বেলা এসব ট্যাক্সি আবার ফিরে এসে শহরের কেন্দ্রে ফিরে আসে, তবে তারা সাধারণত আর পুরো দিনটিতে চলতে দেখা যায় না। এসব চালকরা রাতের কাজ করতে আগ্রহী, কারণ তারা জানেন, সন্ধ্যা ও রাতে তাদের জন্য বেশি আয় হতে পারে।
চালকদের দৃষ্টিভঙ্গি:
গড়িয়ার গঙ্গাজোয়ারা এলাকার এক ট্যাক্সিচালক জানান, “সরকারি আইন, বিশেষত ট্র্যাফিক আইন ও দূষণ নিয়ন্ত্রণের নিয়মাবলী অনেক কঠিন হয়ে গেছে। জরিমানা বাড়ানোয় দিনের বেলায় ট্যাক্সি চালানো সম্ভব হয় না। রাতে নিয়মিত খদ্দের পাওয়া গেলেও, দিনের বেলায় গাড়ি চালাতে গেলে দীর্ঘ দূরত্বে যাওয়ার খরচ বাড়ে।” তিনি আরও জানান, “পাঁচ বছর আগে ভালোভাবে ট্যাক্সি চালিয়ে কর ও অন্যান্য খরচ মিটিয়ে দিনে ৭০০-৮০০ টাকা আয় করতে হত, কিন্তু এখন দিনে এক যাত্রী পেলেই চলে যায়, তারপর রাতে বাঁধা খদ্দের নিয়ে দিনের শেষে ৩-৪শ টাকা আয় হয়।” এই মন্তব্যে স্পষ্ট যে, চলমান পরিস্থিতিতে চালকদের আয় কমে গেছে এবং তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি কার্যকরী সমাধান প্রয়োজন।
ট্যাক্সি সংগঠনের দাবি:
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায়, বিভিন্ন ট্যাক্সি সংগঠনগুলি সরকারের কাছে নিজেদের দাবি জানিয়েছে। যেমন, বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন এআইটিইউসি অনুমোদিত ‘ট্যাক্সি অপারেটর্স কোঅর্ডিনেশন কমিটি’ এবং শাসকদলের সংগঠন ‘আইএনটিটিইউসি’ অনুমোদিত ‘প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সিমেন্স অ্যাসোসিয়েশন’ একযোগে সরকারের কাছে হলুদ ট্যাক্সির (yellow taxis) ভবিষ্যত রক্ষার জন্য সাহায্য চেয়ে একটি যৌথ মঞ্চ তৈরি করেছে। মঞ্চের পক্ষ থেকে পরিবহণমন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তীকে ট্যাক্সি রক্ষায় সক্রিয় সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দেওয়া হবে। ট্যাক্সি চালকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, সরকারের উচিত যাতে পুরনো অ্যাম্বাসাডর গাড়িগুলো, যেগুলো ২০০৮-’০৯ সালে কেনা হয়েছে, তা ট্যাক্সি হিসেবে চালানোর অনুমতি দেয়। কারণ, অনেক চালক এই পুরনো গাড়িগুলোর সেকেন্ড হ্যান্ড মডেল কিনতে আগ্রহী এবং এগুলোর চালানোতে কোনো সমস্যা নেই। এর পাশাপাশি, অন্য গাড়ির সেডান মডেলগুলোও যদি হলুদ ট্যাক্সি হিসেবে চালানো যায়, তাও একটি ভালো পদক্ষেপ হতে পারে।
শম্ভুনাথ দে, ‘প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সিমেন্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক বলেন, “হলুদ ট্যাক্সি আমাদের শহরের পরিচিতি, এবং এর সঙ্গে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা জড়িত। বেশিরভাগ যাত্রী হলুদ ট্যাক্সিকে আস্থার সঙ্গে ব্যবহার করেন। সরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে যদি এই পরিষেবা রক্ষা করা যায়, তাহলে আমাদের শহরও লাভবান হবে।”
সরকারের উদ্যোগ:
সরকার ইতিমধ্যেই জানিয়েছে যে, তারা যে কোনো সংস্থার গাড়ি যদি নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করে, তা হলুদ ট্যাক্সি (yellow taxis) হিসেবে চালানোর অনুমতি দিতে পারে। ইতিমধ্যে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় শহরে পাঁচ হাজার নতুন হলুদ ক্যাব চালু করা হতে পারে, তবে এই বিষয়ে বিস্তারিত কোনও ঘোষণা এখনও করা হয়নি।
কলকাতার হলুদ ট্যাক্সি (yellow taxis) পরিষেবা শুধু শহরের পরিবহণ ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়, এটি শহরের সাংস্কৃতিক পরিচিতিরও একটি চিহ্ন। তবে, আধুনিক প্রযুক্তির কারণে এটি নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ট্যাক্সি চালকদের জন্য আরও সুবিধা, নিয়মকানুনের স্বচ্ছতা এবং সরকারি সহযোগিতা, এই সিস্টেমকে কার্যকরভাবে চালু রাখতে গুরুত্বপূর্ণ হবে। যদি সরকার তাদের দাবি পূরণ করে, তবে এটি শহরের পরিবহণ ব্যবস্থা এবং চালকদের জন্য একটি নতুন আশার আলো হতে পারে।