কৃষ্ণনগরে হয়েছিল ম্যাচ, বিশ্বের প্রথম গেরিলা ফুটবল দল অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু প্রয়াত

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: হাতে মেশিনগান পায়ে বল! এমনই এক দল কোনো দিনই ফিফার স্বীকৃতি পায়নি। তবে লাখ লাখ মানুষের অন্তরে থেকে গেছে। সেখানেই বিলুপ্ত স্বাধীন বাংলা…

Zakaria Pintu

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: হাতে মেশিনগান পায়ে বল! এমনই এক দল কোনো দিনই ফিফার স্বীকৃতি পায়নি। তবে লাখ লাখ মানুষের অন্তরে থেকে গেছে। সেখানেই বিলুপ্ত স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের (Shadhin Bangla football team) স্বার্থকতা। বিশ্বের প্রথম গেরিলা যোদ্ধাদের ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু (Zakaria Pintoo) সোমবার (১৮ নভেম্বর) বাংলাদেশের (Bangladesh) রাজধানী ঢাকায় প্রয়াত হলেন। বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তিনিই দুনিয়ার প্রথম গেরিলা ফুটবলার অধিনায়ক। 

নিজের ফুটবল কেরিয়ারে যতগুলি দেশীয়, আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন জাকারিয়া পিন্টু তা নথিভুক্ত আছে বাংলাদেশ ফুটবল সংস্থার খতিয়ানে। কিন্তু গেরিলা ফুটবলার হিসেবে বিশ্ব কাঁপানো ঐতিহাসিক ম্যাচগুলো ফিফার নথিভুক্ত হয়নি। কারণ, এই ম্যাচগুলো হয়েছিল এমন এক সময় যখন বাংলাদেশ তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে অর্থ সাহায্যের জন্য গঠিত মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের নিয়ে গঠিত স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল বিশ্ব ফুটবল নিয়ামক সংস্থার স্বীকৃতি পায়নি। বিতর্ক আরও বাংলাদেশ সরকারও এই দলকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে ফুটবলের রোমাঞ্চকর ইতিহাসে অলিখিত স্থান পেয়েছে দলটির খেলা।

   

সেদিন কৃষ্ণনগরে…
ঢুকে পড়া যাক কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে। কাতারে কাতারে দর্শক। মাঠের চারদিকে পুলিশ। বাঁশি বাজল। শুরু হয়ে গেল বল নিয়ে গোল করার খেলা। কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে তিল ধারণের জায়গা নেই। গ্যালারি থেকে চিৎকার জয় হিন্দ-জয় বাংলা। কে কোন দলের সমর্থক বোঝার উপায় নেই। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই। ফুটবল ইতিহাসে এক স্বর্ণালী দিন। বিশ্বে প্রথম এমন ম্যাচ যাতে সরাসরি গেরিলা যোদ্ধারা খেলতে নামলেন। প্রতিপক্ষ নদিয়া জেলা একাদশ।

নদিয়ার পাশেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান। সেখানে সংঘর্ষ চলছে। এলাকাটি বাংলাদেশ মুক্তাঞ্চল। অগনিত দর্শক সীমান্তের ওপারে কুষ্টিয়া-মেহেরপুর থেকে কৃষ্ণনগরে এসেছেন নিজেদের দলের খেলা দেখতে। আছেন কৃষ্ণনগরবাসীরা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে জড়িয়ে আছে বল দখলের খেলা। সেদিন পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ কৃষ্ণনগর স্টেডিয়াম। নদিয়া জেলা প্রশাসন কর্তাদের ঘুম উড়ে গেছে। যে সে ব্যাপার নাকি! এতজন গেরিলা যোদ্ধা খেলতে নেমেছে। আজ খেলবে, কাল যুদ্ধে নামবে! কাল কী হবে কেউ জানে না।

পাকিস্তানি সেনার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধ চলছিল পূর্ব পাকিস্তানের মাঠে ঘাটে। এই রক্তাক্ত অধ্যায়ের এক পর্বে ফুটবলের বাঁশি বেজেছিল। বাঙালির রক্তে মিশে থাকা খেলা। ফিফা মানেনি, মেনেছে কোটি কোটি হৃদয়… ফিফা স্বীকৃত না হলেও এই ফুটবল ম্যাচ হয়েছে গবেষণার বিষয়। 

খেলা চলছে। নদিয়া জেলা দল বনাম ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’-এর, যেটি বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়া। আর নদিয়ার দল একপ্রকার ভারতীয় একাদশের ভূমিকা নিয়েছে।

‘মুক্তি’ লোকেরা কেমন? যাদের কথা রোজ কাগজে আসছে, আকাশবাণীর সংবাদে বলছে, তাদের দেখতেই দর্শকদের বেশি আগ্রহ। কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামের দর্শকরা প্রবল উত্তেজিত। গেরিলা ফুটবল দলটির সবাই পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে এসেছেন। তাদের সমর্থকরাও সীমান্তের ওপারে মুক্তাঞ্চল দিয়ে নদিয়া ঢুকেছেন। প্রবল আক্রমণাত্মক ম্যাচটি ২-২ গোলে অমীমাংসিত হয়েছিল।

প্রথমবার রবীন্দ্রনাথ রচিত দুই জাতীয় সঙ্গীত সেদিন খেলার আগে কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে একইসঙ্গে বেজেছিল দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত। তথ্য পরম্পরা মিলিয়ে নিলে ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই বিশ্বে প্রথমবার রবীন্দ্রনাথের লেখা দুটি জাতীয় সঙ্গীত বেজেছিল কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশ সরকারিভাবে তখনও স্বীকৃত নয়। তবে কলকাতায় থাকা প্রবাসী মুজিবনগর সরকার (অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার) আগেই রবীন্দ্রনাথ রচিত ‘আমার সোনার বাংলা…’কে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেয়।

চাকরি গেল ভারতীয় আমলার!
বিতর্ক মিশে আছে এই ম্যাচে। তখনও আন্তর্জাতিকভাবে অস্বীকৃত বাংলাদেশ। সেই দেশের পতাকা ওড়ানোর দায়ে নদিয়ার তৎকালীন জেলা কর্তা (ডিসি) দীপক ঘোষকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কারণ তিনি কূটনৈতিক প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করেছিলেন।

গেরিলা ফুটবল অভিযান
৩৪ জন খেলোয়াড়, ম্যানেজার এবং কোচ সহ মোট ৩৬ জন নিয়ে গড়া ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল’ দলের অধিনায়ক ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। সহ অধিনায়ক ছিলেন প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। কোচ ছিলেন ননী বসাক। গেরিলা বাহিনীর ফুটবল দল পরপর ১৬টি ম্যাচ খেলেছিল ভারতে। কলকাতায় সৌজন্য ম্যাচে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে (গোষ্ঠপাল একাদশ) ও মুম্বইতে (তখন বম্বে) মহারাষ্ট্র দলের বিরুদ্ধে খেলে। মোট ১২টি ম্যাচে জয়ী হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল’। প্রায় ৫ লক্ষ টাকা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগ্রহ করে।