বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পে মন্দার জেরে চলতি বছর কমেছে সিনোর সংখ্যা

কলকাতা, ১৯ অক্টোবর: বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পে (Bengali Film Industry) চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৪-এ সিনেমা মুক্তির সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে কমেছে। ২০২৩ সালে যেখানে ৬৩টি বাংলা সিনেমা মুক্তি…

Bengali Film Industry

কলকাতা, ১৯ অক্টোবর: বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পে (Bengali Film Industry) চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৪-এ সিনেমা মুক্তির সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে কমেছে। ২০২৩ সালে যেখানে ৬৩টি বাংলা সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল, ২০২৪-এ এখনও পর্যন্ত মাত্র ৩৮টি বাংলা ছবি মুক্তি পেয়েছে। বছরের শেষ পর্যন্ত আরও পাঁচ থেকে ছয়টি ছবি মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও মোট সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৪৪ বা ৪৫-এ, যা গত বছরের তুলনায় ১৮টি কম। এই হ্রাসপ্রবণতা শুধু সিনেমার সংখ্যাতেই নয়, ব্যবসার সামগ্রিক অঙ্কেও স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে, যা চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ও প্রযোজকদের মধ্যে নতুন করে চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মুক্তির সংখ্যা হ্রাসের পেছনের কারণ
বাংলা চলচ্চিত্র মুক্তির সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ বিশেষজ্ঞরা তুলে ধরছেন। প্রথমত, কোভিড-১৯ মহামারীর পরবর্তী পরিস্থিতিতে দর্শকরা এখনও হলমুখী হতে পুরোপুরি অভ্যস্ত হতে পারেননি। অনেকেই অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে ছবি দেখার দিকে বেশি ঝুঁকেছেন। এছাড়াও, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলা ছবির প্রযোজনা খরচও অনেক কম, ফলে মানের ক্ষেত্রে কিছুটা আপোষ করা হয়, যা দর্শকদের হল থেকে দূরে রাখছে।

   

দ্বিতীয়ত, বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে বড় বাজেটের ছবির সংখ্যা কম এবং সফল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে সিনেমা তৈরির প্রবণতাও তুলনামূলকভাবে কমেছে। কিছু পরিচালক ও প্রযোজক নিরীক্ষাধর্মী এবং স্বল্প বাজেটের ছবির দিকে ঝুঁকছেন, যেগুলি বক্স অফিসে তেমন সাফল্য পাচ্ছে না।

তৃতীয়ত, বিদেশি ও হিন্দি সিনেমার বাজার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তারা পশ্চিমবঙ্গের দর্শকদের একটি বড় অংশ আকর্ষণ করছে। বলিউড এবং দক্ষিণী সিনেমার দুর্দান্ত ভিএফএক্স, বড় তারকা এবং দারুণ প্রোডাকশন কোয়ালিটির তুলনায় বাংলা ছবির অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে।
ব্যবসায়িক মন্দা

বাংলা চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক অঙ্কও ২০২৪ সালে উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। চলচ্চিত্র মুক্তির সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বক্স অফিসের আয়ও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। বড় বাজেটের ছবি না থাকায় এবং সফল বাণিজ্যিক ছবি তৈরি না হওয়ায় প্রযোজকরা আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছেন। ২০২৩ সালে কিছু ছবির উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখা গেলেও, ২০২৪ সালে তেমন কোনও ব্লকবাস্টার বাংলা ছবি এখনও বক্স অফিসে দেখা যায়নি।

কলকাতার একজন চলচ্চিত্র বিশ্লেষক জানালেন, “বাংলা ছবির বাজারে বড় ধরনের কোনও সাফল্য আসেনি ২০২৪ সালে। ছবির মুক্তির সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসার ক্ষেত্রে আমরা একটি স্থবির অবস্থায় পৌঁছেছি। নতুন পরিচালক এবং প্রযোজকরা চেষ্টা করছেন নতুন ধরনের কনটেন্ট নিয়ে আসতে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেগুলির সাফল্য সীমিত।”

২০২৫-এও একই ধারা?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ২০২৫ সালেও বাংলা ছবির মুক্তির সংখ্যা ৪৫-এর কাছাকাছিই থাকবে। এই সংখ্যা নিয়ে চলচ্চিত্র মহলে উদ্বেগ থাকলেও, অনেকেই মনে করছেন যে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে এবং বাংলা ছবির পুরনো সাফল্যের দিন ফিরে পেতে প্রযোজক, পরিচালক ও শিল্পীদের আরও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

তবে, কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। কন্টেন্টের দিক থেকে বাংলা ছবি একটি নীরব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ছোট বাজেটের ছবিতে নতুন নতুন গল্প তুলে ধরা হচ্ছে, যা কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণির দর্শকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কিছু পরিচালক বলছেন, ব্যবসার দিক থেকে তাৎক্ষণিক লাভ না হলেও, এই ধরনের ছবির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকতে পারে।

প্রযোজকদের প্রতিক্রিয়া
অনেক প্রযোজক এই অবস্থায় নিজেদের নিরাপদ রাখতে চাইছেন। বাংলা ছবির বাজেট কমিয়ে আনতে গিয়ে তারা নতুন ধরনের গল্প এবং কনটেন্টে ঝুঁকছেন। তবে বড় বাজেটের ছবির প্রযোজনাও বাদ দিচ্ছেন না। একজন প্রযোজক জানালেন, “আমরা চাই নতুন প্রজন্মের জন্য আকর্ষণীয় গল্প তুলে ধরতে, তবে বড় বাজেটের ছবির ক্ষেত্রেও আমরা ঝুঁকি নিতে রাজি আছি যদি গল্পটি দর্শকদের মধ্যে পৌঁছায়।”

তবে, কিছু প্রযোজক এই অবস্থায় বাংলা চলচ্চিত্রের ভবিষ্যত নিয়ে হতাশ। একজন প্রখ্যাত প্রযোজক বলেন, “প্রতিযোগিতার বাজারে বাংলা ছবির টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে। বড় বাজেটের হিন্দি ও দক্ষিণী ছবি আমাদের বাজারে ঢুকে পড়েছে, আর দর্শকরাও এখন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছেন। আমরা যদি দর্শকদের হলে ফিরিয়ে আনতে না পারি, তাহলে চলচ্চিত্র মুক্তির সংখ্যা কমতেই থাকবে।”

ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে
বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের সামনে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। বড় প্রযোজনার ছবি না থাকলে এবং বাণিজ্যিকভাবে সফল ছবির সংখ্যা কমলে এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠা কঠিন হতে পারে। তবে পরিচালক এবং প্রযোজকরা যদি যুগোপযোগী কনটেন্ট এবং দর্শকদের জন্য আকর্ষণীয় গল্প নিয়ে আসতে পারেন, তাহলে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প নতুন করে জেগে উঠতে পারে।

বাংলা ছবির নতুন দিশা কী হতে পারে, তা সময়ই বলবে। তবে আপাতত ২০২৫ সালে বাংলা ছবির মুক্তির সংখ্যা ৪৫-এর কাছাকাছিই থাকবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।