প্রসেনজিৎ চৌধুরী: প্রাচীণ ব্যাবিলনীয় গাথায় লেখা দুধ ও মধু বয়ে যায় এমন জায়গা হল প্যালেস্টাইন। এর অধিকার ভৌগোলিকভাবে আরব জাতির। আর ইহুদি ধর্মীয় তত্ত্ব অনুসারে দুধ-মধু বহমান জায়গা তাদেরই। মূলত এই দ্বন্দ্বই চলছে যুগ যুগ ধরে। দ্বন্দ্বের কেন্দ্রভূমি জেরুজালেম। এই শহরের দাবিদার যেমন ইজরায়েল তেমনই দাবিদার প্যালেস্টাইন। আরব জাতিভুক্ত ফিলিস্তিনিরা ইসলাম অনুসারী। আর ইজরায়েলিরা ইহুদি বা যিউশ ধর্মাবলম্বী। ফলে আরব-ইজরায়েলি জাতিগত সংঘর্ষের রেশ ইসলাম বনাম ইহুদি ধর্মকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নির্দেশে জার্মানির নাৎসি সরকার লাখ লাখ ইহুদি নিধন করেছিল। বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইহুদিদের পুনর্বাসনের জন্য আরব দুনিয়ার মাঝে প্যালেস্টাইনের অংশ কেটে ইজরায়েল দেশ তৈরি করা হয়। এরপর শুরু হয় গোপনে থাকা নাৎসি অফিসারদের বিভিন্ন দেশে থেকে তুলে এনে চরম শাস্তিদানের ইজরায়েলি প্রতিশোধ পর্ব। এই কাজে বিশ্বকে বারবার শিহরিত করেছে ইজরায়েলি গুপ্তচর বিভাগ মোসাদ (Mossad)।
ইজরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ তীক্ষ্ণ বুদ্ধিতে প্রতিপক্ষ শিবিরে ভয়াবহ হামলার (Mossad Attack) জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পর এর পরেই দেশটির গুপ্তচর বিভাগ ব্যাপক শক্তিশালী করে তুলতে পরিকল্পনা করেছিলেন ডেভিড বেনগুরিয়েন। ইজরায়েলের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বেনগুরিয়েনের পরিকল্পনার ফলে সে দেশের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা বিভাগ ‘শেনবেত’ শক্তিধর হয়। এরপর প্রতিপক্ষ আরব জাতির বিশেষত ফিলিস্তিনি গেরিলা সংগঠনগুলির হামলা মোকাবিলায় গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের জন্ম হয়।
বেনগুরিয়েনের তত্ত্ব মেনে পরবর্তী সময়ে ইজরায়েল সরকার মোসাদ-কে আরও শক্তিশালী করেছে। বিশ্বজুড়ে সক্রিয় তারা। এভাবেই একদা ‘র’ সংশ্লিষ্ট প্রাক্তন ভারতীয় আমলা অশোক গুপ্ত বিক্রমাদিত্য ছন্দনামে ইজরায়েলের গুপ্তচর বিভাগের জন্ম ইতিহাস ও কার্যপ্রণালী লিখেছেন ‘মাকড়সার জাল’ বইতে।
মোসাদের কূটকৌশলকে স্বীকার করে সব দেশ। তবে বিশ্ববন্দিত ইজরায়েলের এই গুপ্তচর বিভাগ ও তাদের নিরাপত্তা বলয় ভেঙে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন (জঙ্গি তালিকাভুক্ত) হামাস করেছিল হামলা। প্যালেস্টাইনের অংশ গাজা থেকে হামাসের হামলায় ইজরায়েল হয়েছিল রক্তাক্ত। দশকের পর দশক ফিলিস্তিনি গণহত্যায় অভিযুক্ত ইজরায়েল। সে দেশে ঢুকে গণহত্যা করেছিল হামাস। সেই হামলার রেশ ধরে সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য-আরব বিশ্বসহ গোটা দুনিয়া বারবার গরম হয়েছে। ইজরায়েলের প্রতিপক্ষ আরব জাতিভুক্ত বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠন যেমন ইয়েমেনের হুথি গোষ্ঠী, লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী (দুটি সংগঠনই জঙ্গি তালিকাভুক্ত) বারবার হামলা চালিয়েছে।
তাৎপর্যপূর্ণ, ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস ইজরায়েলের অত্যাধুনিক নিরাপত্তা বলয় (আকাশেই শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র ধংস ব্যবস্থা) ‘আয়রন ডোম’ ভেঙে মিসাইল বৃষ্টি ঘটিয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছিল ইজরায়েলের নিরাপত্তার আস্ফালন নিয়ে। হামাসের ঘনিষ্ঠ লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীও ইজরায়েলের সুরক্ষা ভেঙে একাধিক হামলা করেছে
শুরু হয় ইজরায়েলের বদলা পর্ব। হামাস ও হিজবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ ইরান। সে দেশে কড়া নিরাপত্তায় থাকা হামাসের রাজনৈতিক প্রধানকে দূর নিমন্ত্রিত বোমা বিস্ফোরণে খতম করে বিশ্বজুড়ে চাঞ্চল্য ফেলে দেয় ইজরায়েলি গুপ্তচর বিভাগ মোসাদ। এবার তাদের লক্ষ্যবস্তু লেবানন। এ দেশেই আছে হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর মূল ঘাঁটি। মিসাইলে শক্তিশালী এই গোষ্ঠী বকলমে লেবাননের ক্ষমতাধর। তারাই নিজ দেশে মোসাদের কূটবুদ্ধিতে ছিন্নভিন্ন।
নিজেদের গোপন রাখতে হিজবুল্লাহ সদস্যরা প্রায় অচল পেজার কমিউনিকেশন ব্যবহার করে। সেই পেপার টেকনোলজির ভিতর অতি উচ্চ রেডিও তরঙ্গ পাঠিয়ে ধারাবাহিক বিস্ফোরণ ঘটানোয় অভিযুক্ত মোসাদ। মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) লেবাননে ধারাবাহিক পেজার বিস্ফোরণে হিজবুল্লাহর ভিতর চরম আতঙ্ক। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) লেবাননে হল ধারাবাহিক ওয়াকিটকি বিস্ফোরণ। একাধিক নিহত। বিশ্ব ফের শিহরিত।
প্রতিশোধ নিতে মোসাদ কী করতে পারে তা গত ষাট-সত্তর বছর ধরে প্রমাণিত। হিজবুল্লাহ গোষ্ঠী এখন মোবাইল, ল্যাপটপসহ যে কোনোরকম ডিভাইস ব্যবহার করতে ভয় পাচ্ছে।