‘এক টুকরো এক রোদের জন্মদিন’, ফিরে এসে জিতে যাওয়া

আদিত্য ঘোষ, কলকাতা: কথিত আছে অর্জুন তির মারার সময় মাছের চোখ দেখেছিল। এক দৃষ্টিতে। স্থির হয়ে। লক্ষ্যভেদ করার জন্য তিনি সময় নিয়েছিলেন বটে কিন্তু লক্ষ্যভেদ…

আদিত্য ঘোষ, কলকাতা: কথিত আছে অর্জুন তির মারার সময় মাছের চোখ দেখেছিল। এক দৃষ্টিতে। স্থির হয়ে। লক্ষ্যভেদ করার জন্য তিনি সময় নিয়েছিলেন বটে কিন্তু লক্ষ্যভেদ করেছিলেন। মহাভারতের সেই ঘটনা আজ বড্ড প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। মেয়েটার বয়স মাত্র বাইশ। চোখেমুখে মেজাজী ছাপ। কিন্তু দৃষ্টি স্থির। লক্ষ্যভেদ করতে তিনি মনে যপেছিলেন কৃষ্ণের পরামর্শ। মহাভারতে অর্জুন কৃষ্ণকে বলেছিলেন, ‘লক্ষ্যে স্থির থাকো।’ সেই পরামর্শ মনু ভাকেরকে (Manu Bhaker) উদ্বুদ্ধ করেছিল। দেশকে দু’দিনের ব্যবধানে পদক দিয়েছেন। এটাই হয়ত ক্রিকেট হলে এতক্ষণে রে রে রব উঠত। কিন্তু মনু জানেন এই আলসেমিতে গা ভাসানোর কোনও মানে নেই। তিনি নিজের লক্ষ্যে শুধু স্থির থেকেছেন। নিজেকে নিজের থেকে ভেঙে আবার নতুন করে গড়েছেন। স্মিত হাস্যে পদক নিয়ে যেন মনে মনে বলেছেন, ‘ লক্ষ্যে স্থির থাকতে হবে।’

Anwar Ali: ‘আমরা মোহনবাগান…’, আনোয়ার ইস্যুতে মুখ খুললেন গোয়েঙ্কা

   

প্রসঙ্গত পদক জিতে অনন্য নজির গড়লেন হরিয়ানার তরুণ শুটার। স্বাধীনতার পরে একমাত্র ভারতীয় হিসাবে একই অলিম্পিক থেকে দুটি পদক জেতার রেকর্ড গড়লেন মনু। ১৯০০ সালে ভারতীয় হিসাবে এই নজির ছিল নর্ম্যান প্রিচার্ডের। সেবার অলিম্পিকে অ্যাথলেটিক্স থেকে দু’টি রুপো জিতেছিলেন তিনি। তবে সে’সময় ভারত ছিল ব্রিটেনের উপনিবেশ। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরে আর কোনও ভারতীয় ক্রীড়াবিদ একই অলিম্পিক থেকে জোড়া পদক নিয়ে দেশে ফিরতে পারেননি। সেই ‘অসাধ্য’ সাধন করলেন ভারতের শুটার। প্যারিসে ভারতের পদকের খাতা খুলেছেন মনু ভাকের। দীর্ঘ এক যুগ পর শুটিংয়ে পদক জিতেছে ভারত। শুধু তাই নয়, ভারতের প্রথম মহিলা শুটার হিসেবে পদক জিতে ইতিহাস গড়েছেন। প্যারিসে প্রথম সাফল্যের পর মনু ভাকের বলেছিলেন, একটা পদকেই থামতে চান না। রবিবার ১০ মিটার এয়ার পিস্তলের ব্যক্তিগত বিভাগে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন মনু। একই অলিম্পিক্সে দু’টি পদক জয়ের কীর্তি গড়লেন তিনি। এর আগে ভারতের সুশীল কুমার এবং পিভি সিন্ধুর অলিম্পিক্সে দু’টি পদক জয়ের নজির ছিল। কিন্তু একই অলিম্পিক্সে একাধিক পদক জিততে পারেননি তাঁরা। সেই কাজটাই করে দেখালেন মনু। মঙ্গলবার দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম সিরিজ়ে পয়েন্ট হারিয়েছিল ভারত। পরের চারটি সিরিজ়ে জিতে এগিয়ে যান মনুরা। মনে হচ্ছিল সহজেই জিতবেন তাঁরা। কিন্তু কোরিয়া ম্যাচে ফিরে আসে। তারা লড়াই করছিল। যদিও কখনওই ভারতকে টপকে এগিয়ে যেতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত ১৬-১০ স্কোরে ব্রোঞ্জ জিতে নেন মনুরা।

Mohun Bagan: ১০ মিনিটে সুহেলের হ্যাটট্রিক, মোহনবাগানের ৫ গোল

এবার একটু ফিরে যাওয়া যাক অতীতে। সময়টা ২০২০। টোকিও অলিম্পিক থেকে ফিরতে হয়েছিল মনুকে। তারপর থেকে চরম মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল মনুকে। তিনি একটুতেই মেজাজ দেখাতে শুরু করেন। কারুর সঙ্গে বিশেষ কথা বলতেন না। একটুতেই চটে যেতেন। নিজেকে সমাজমাধ্যমের বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। নিজের খেলার প্রতি আরও একাগ্রতা বাড়ানোই ছিল তাঁর লক্ষ্য। মাঝে চারটে বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কেটে গিয়েছে অনেক দিন। তিনি নিজেকে নিজের জন্য তৈরি করেছিলেন। একদম শেষপর্যন্ত লড়াই করার জন্য। দ্বিতীয়বার পদক জয়ের পরে তাঁর শরীরী ভঙ্গি ছিল ধীর স্থির এবং স্মিত হাস্য। মনু বলেন, ‘আসলে, সব সময় সব কিছু আমাদের হাতে থাকে না। যেটা আমাদের হাতে রয়েছে সেখানেই সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করি। প্যারিসে আসার আগেই আমি আর সরবজ্যোৎ ঠিক করেছিলাম, অন্য কোনও দিকে মন দেব না। ইভেন্টের দিন নিজেদের সেরাটা দেব। তার পর যা হবে দেখা যাবে। যা-ই হোক না কেন, সেটা মেনে নেব। শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব।’

মনুর ফিরে আসা হয়ত একটা রূপকথার গল্পের চেয়েও বৃহৎ। একটা বিরাট শূন্য থেকে একশতে ফিরে আসা। যে ফিরে আসায় বারেবারে শুধুমাত্র লক্ষ্যে স্থির থাকার বার্তায় রয়েছে। যে রূপকথায় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াতে সামিল হওয়ার বার্তা রয়েছে। এই দেশ, এই বিকেল, এই আলো সবকিছু তারিফ করছে মনু ভাকেরের। স্যালুট মেয়ে। স্যালুট মনু।