প্রসেনজিৎ চৌধুরী: সৈনিক জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অপেক্ষা করা সমীচিন নয়। পাকিস্তানি সেনার ঘেরাটোপে থাকা ঢাকা দখলের প্রথম গৌরবের হাতছানি। সবমিলে প্রবল মানসিক টানাপোড়েনে রয়েছেন ভারতীয় সেনার মেজর জেনারেল নাগরা। অপরপক্ষে তাঁর ‘বন্ধু’ এখন প্রতিপক্ষ ‘শত্রু’ পাকিস্তানি লেফট্যানেন্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। যুদ্ধ দুজনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। মাঝে একটি সেতু। বিখ্যাত মিরপুর ব্রিজ।
তৎকালীন সময়ে তো বটেই এখনও ঢাকা মহানগরীর অন্যতম একটি সেতু। এই সেতুর দুই মুখে পজিশন নিয়েছে দু পক্ষ। একদিকে ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ সেনা অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনা।
ঢাকার বিখ্যাত মিরপুর ব্রিজের পাকিস্তানের দিক থেকে গুলি বর্ষণ বন্ধ হয়েছিল। উত্তেজিত জেনারেল নাগরা ডেকে নিলেন তাঁর সহকারি অফিসারদের। তাঁর বাহিনীকে পুরো সহযোগিতা করছে কিংবদন্তি মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকীর (বাঘা সিদ্দিকী) কাদেরিয়া বাহিনী।
৫০ বছর আগে মিরপুর সেতুতে ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর টানা দুটো দিন ঘটেছিল সেই নাটকীয় মুহূর্তের প্রথম পর্বটি। এই সেতুর এক প্রান্ত থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সেনা কমান্ডার নিয়াজির কাছে একটি চিরকুট পাঠিয়েছিলেন ভারতীয় সেনা কর্তা গন্ধর্ব সিং নাগরা।
কী লিখেছিলেন মেজর জেনারেল নাগরা?
“My dear Abdullah, I am here. The game is up, I suggest you give yourself up to me and I will take care of you, Nagra”
(প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। ঘটনার পরিসমাপ্তি হয়েছে। পরামর্শ হচ্ছে, আপনি আমার কাছে আত্মসমর্পণ করুন। সেক্ষেত্রে আমরা আপনাদের দেখাশোনার দায়িত্ব নেব, শীঘ্র আপনার প্রতিনিধি পাঠান। নাগরা)
নাগরা ও নিয়াজি পরস্পর পরিচিত। দুই দেশের দুই শীর্ষ সেনা কর্তা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দুজনকে ঐতিহাসিক চরম মুহূর্তে টেনে এনেছিল।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা ‘আমি বিজয় দেখেছি’ বইতে নাগরা ও নিয়াজির সম্পর্ক লিখেছেন এম আর আখতার মুকুল। তিনি তৎকালীন মুজিবনগর সরকার (প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার) এর তরফে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম কর্তা। তিনি লিখেছেন, ‘ বছর কয়েক আগে জেনারেল নাগরা যখন ইসলামাবাদে ভারকীয় দূতাবাসে মিলিটারি এট্যাচি হিসেবে চাকরি করতেন, তখন থেকে নিয়াজীর সঙ্গে তার পরিচয়’ (বানান অপরিবর্তিত)
সেদিন নাগরার চিরকুট পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সেনা কর্তা আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি (এ এ কে নিয়াজি)। ঢাকার পাক সেনা কার্যালয়ের সেই গুমোট ভয়ানক পরিবেশের বর্ণনা দিয়েছেন পাকিস্তানি আমলা সিদ্দিক সালিক তাঁর লেখা ‘Witness to surrender’ (আত্মসমর্পণের সাক্ষী) বইতে।
তিনি লিখেছেন, নাগরার বার্তা হাতে নিয়ে পড়ার পর নিয়াজির চেহারাটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তিনি কোনও কথা না বলে চিঠিটা অন্যদের পড়তে দিলেন। সবাই বার্তাটা দেখলেন। মিনিট কয়েক জন্য সেখানে কবরের নিস্তব্ধব্ধতা নেমে এলো।