বর্তমান যুগে ট্যাটু এক ধরনের ফ্যাশন। তবে এমন এক ধরনের জায়গা আছে যেখানে ট্যাটু করা বাধ্যতামূলক। সেখানকার মেয়েদের মুখে ট্যাটু আঁকাতে হয় শিশুকালেই। মায়ানমারের(Mayanmar) পার্বত্য অঞ্চলের চিন রাজ্যের নারীরা তাদের ট্যাটুর(Tattoo) জন্য বিখ্যাত। পুরো বিশ্বে এই নারীদের তাদের ট্যাটুর জন্য আলাদাভাবে দেখা হয়।
প্রায় ৫ লাখ মানুষের বাস এই চিন রাজ্যে। ১২ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে প্রত্যেক নারীর মুখে এঁকে দেওয়া হয় এই ট্যাটু। অর্থাৎ তাদের চেহারা বিকৃত করে দেওয়া হয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে চলে আসছে এই রীতি। মায়ানমারের পার্বত্য অঞ্চলে শত শত বছর ধরে বাস করে এই উপজাতি মানুষ।
কয়েকশো বছর ধরে এই উপজাতির মানুষরা আধুনিক প্রজন্ম থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল বলা যায়। তবে পর্যটকদের আনাগোনায় তারা পুরো বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে। ট্যাটু করার পেছনে কারণ হিসেবে প্রচলিত রয়েছে এক কাহিনী।
একবার বার্মিস রাজা ঘুরতে এসেছিলেন এখানে। সে সময় এক নারীর রূপে মুগ্ধ হন রাজা। সেই নারী ছিলেন বিবাহিতা তবুও তাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয় রাজার জন্য। একপর্যায়ে পালিয়ে আসতে সমর্থ হন সেই নারী। কিন্তু সংকা যেন আর কাটে না কখন যেন রাজার লোকেরা ধরে নিয়ে যায়। আর ঠিক তখনই ছুরি দিয়ে নিজের মুখমণ্ডল বিকৃত করে নেয় ওই নারী।
কারণ সেই রাজা নিজের ইচ্ছে মত যে কোনও নারীকে ধরে নিয়ে যেতেন। এতে মেয়েটির সম্মতি থাকুক বা না থাকুক। তবে সেই মেয়েটিকে কখনোই স্ত্রীর মর্যাদা দিতেন না। রাখা হতো উপপত্নী করে। যখন ইচ্ছে একজনকে ত্যাগ করে আবার অন্য একজনকে সঙ্গী করত। রাজার মতের বিরুদ্ধে যাওয়া কারোর সাধ্যে ছিল না।
সেক্ষেত্রে নিজের সম্মান রক্ষাত্রে মুখমন্ডলের ট্যাটু করে তারা নিজেদের রক্ষা করতো। সবাই জানত রাজকীয় শক্তির বিরোধিতা মানেই বিপদ। তাই তারা এই পথ বেছে নেয়। এতে ট্যাটু শিল্পেও বেশ সৃজনশীল হয়ে ওঠে। এরপর মুখে ট্যাটু করা এদের এক সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। একবার ট্যাটু করতে প্রায় পুরো দিন সময় লেগে যেত। এই ট্যাটু আঁকাতে ভয়ানক যন্ত্রণাও হত।
বিশেষ করে চোখের পাতায় ট্যাটু করার সময় যন্ত্রণা প্রবল আকার ধারণ করত। শরীরের যে অংশে ট্যাটু করা হয় তার লোহা দিয়ে তার ওপর গরু ছাগল বিভিন্ন জন্তুর চর্বি লাগানো হয়। একবার ট্যাটু আঁকলে প্রায় ৬ থেকে ৭ দিন স্থায়ী হয়। তারপর আবার এই ভাবেই ট্যাটু আঁকা চলতে থাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।
বেশিরভাগ নারী ট্যাটু আঁকেন মাকড়সার জালের মতো করে। তবে এলাকা ভেদে এই ট্যাটুর নকশাও আলাদা। নকশা দেখে বলে দেওয়া যায় কোন নারী কোন এলাকার। আলাদা ছয়টি জাতি আছে এদের মধ্যে তারা কপালে বি, ডি, পি, ওয়াই এমন ইংরেজি অক্ষর লেখেন। তারা ট্যাটু আঁকতে লোহার দন্ড ছাড়াও পাতা, ঘাসের আগা, বেতের কাঁটা ও কাঁচের টুকরো ব্যবহার করেন। কালি তৈরি হয় পশুর চর্বি পুড়িয়ে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রথা পরিণত হয় এক চিত্রকর্ষ শিল্পে। প্রথমে মেয়েদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে শুরু হলেও পরে তার বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। আর এটি হয়ে দাঁড়ালো চিন রাজ্যের নারীদের গৌরবের বিষয়। তবেই ট্যাটু করার পেছনে রয়েছে আরেকটি ব্যাখ্যা। সেটি অবশ্য ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত।
ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় থেকে চিন রাজ্যের অনেক সংখ্যা লঘুরা খ্রিস্টান ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে। স্থানীয়রা যাজকরা বলতেন শুধু যারা ট্যাটু করেছে তারাই স্বর্গে যাওয়ার উপযুক্ত। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পূর্ণমাত্রায় প্রচলিত ছিল এই ট্যাটু করা। এরপর থেকেই পদক্ষেপ নেয় দেশের সরকার।
তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নারীরা এখনো মানতে নারাজ সরকারের এই নিয়ম। মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতে বিশাল আকৃতিরর কানের দুল পড়েন তারা। তবে নতুন প্রজন্ম দিন দিন বিরক্ত হয়ে উঠছে এই প্রথার প্রতি। নিজেদের সুন্দর মুখমন্ডল আর বিকৃত করতে চায়না তারা। মায়ানমারের সামরিক সরকার ট্যাটু আঁকলে তার ওপর জরিমানা বিধান করেছিল। সেই ভয়ে অনেকে ট্যাটু আঁকতে চায় না।