কোয়েতা, ৩ ডিসেম্বর ২০২৫: পাকিস্তানের রাজনৈতিক মহলে এক চাঞ্চল্যকর (Pakistan political crisis) ঘটনা ঘটেছে। প্রাক্তন অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী আনওয়ারুল হক কাকার কোয়েতায় একটি গুলিবর্ষণের ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। তাকে তাৎক্ষণিক স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ঘটনার বিস্তারিত তথ্য এখনও অপেক্ষমাণ, কিন্তু এই ঘটনা পাকিস্তানের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরও একটি উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সূত্রগুলো জানাচ্ছে, এটি একটি টার্গেটেড অ্যাটাক হতে পারে, যা বেলুচিস্তানের উত্তেজনাময় পরিবেশের সাথে যুক্ত।
আনওয়ারুল হক কাকা, যিনি ২০২৩ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বেলুচিস্তানের একজন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। তিনি পশতুন জাতীয় জোটের (PDA) নেতা এবং সেনেটর হিসেবে পরিচিত। তার নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছিল, যা পরবর্তীতে বিতর্কিত হয়ে ওঠে। কোয়েতা, বেলুচিস্তানের রাজধানী, দীর্ঘদিন ধরে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর আড্ডা হিসেবে পরিচিত। বেলুচ লিবারেশন আর্মি (BLA) এবং অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠী এই অঞ্চলে ঘন ঘন হামলা চালিয়ে আসছে, যা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করছে।
স্থানীয় সূত্র এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত প্রাথমিক খবর অনুসারে, ঘটনাটি বিকেলের দিকে কোয়েতার একটি ব্যস্ত রাস্তায় ঘটেছে। কাকার গাড়িতে আক্রমণকারীরা গুলি চালিয়েছে, যার ফলে তিনি বাহু এবং পায়ে আহত হন। তার সাথে ছিলেন দুজন নিরাপত্তা কর্মী, যারা অক্ষত রয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন যে, কাকার অবস্থা গুরুতর কিন্তু স্থিতিশীল। তাকে আইসিইউতে রাখা হয়েছে এবং অতিরিক্ত চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানের স্বাস্থ্য মন্ত্রক এবং স্থানীয় পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে, কিন্তু এখনও কোনো গোষ্ঠী দায় স্বীকার করেনি।
এই ঘটনা পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করেছে। আনওয়ারুল হক কাকা তার রাজনৈতিক জীবনে বেশ কয়েকবার বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছেন। ২০২৩ সালের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় তিনি বেলুচিস্তানের উন্নয়ন এবং নিরাপত্তা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তবে, তার সরকারের সময় বেলুচিস্তানে বিদ্রোহীদের হামলা বেড়ে যায়, যা চীনা কর্মীদের উপর আক্রমণের মতো ঘটনায় পরিণত হয়। চীনা সরকার তখন এই হামলাগুলোর নিন্দা করে এবং পাকিস্তানকে আরও কড়া ব্যবস্থা নিতে বলে। কাকার নেতৃত্বে পাকিস্তান সি-পি সি (চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর) প্রকল্পের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়, কিন্তু এটি বিদ্রোহীদের ক্রোধের কারণ হয়ে ওঠে।
বেলুচিস্তানের প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা আরও গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রদেশটি পাকিস্তানের সবচেয়ে সম্পদসমৃদ্ধ অঞ্চল, কিন্তু দারিদ্র্য এবং বিচ্ছিন্নতার কারণে বিদ্রোহের শিকার। ২০০৪ সাল থেকে বেলুচ লিবারেশন ফ্রন্ট এবং BLA-এর মতো গোষ্ঠী স্বায়ত্তশাসন দাবি করে হামলা চালিয়ে আসছে। ২০২৫ সালে এই অঞ্চলে ইতিমধ্যে কয়েকটি বড় হামলা ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, জুলাই মাসে কোয়েতায় একটি ম্যাগনেটিক আইইডি বিস্ফোরণে পাকিস্তান আর্মির মেজর আনওয়ার কাকার (একই উপাধি, কিন্তু ভিন্ন ব্যক্তি) মৃত্যু হয়, যা BLA দায় স্বীকার করে। সেপ্টেম্বরে ফ্রন্টিয়ার কর্পস হেডকোয়ার্টারের কাছে সুইসাইড বোম্ব হামলায় ১০ জন নিহত হয়। এই ঘটনাগুলো বেলুচিস্তানকে একটি ‘হটস্পট’ বানিয়ে তুলেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই আক্রমণ কাকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের সাথে যুক্ত হতে পারে। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (PML-N) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (PPP)-এর নেতারা কাকাকে অভিযোগ করেছেন যে, তার সরকার নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছে। ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (PTI) কাকার সময়কার নির্বাচনকে ‘চুরি’ বলে অভিহিত করে। এছাড়া, সাম্প্রতিককালে পাকিস্তানের আর্মি চিফ জেনারেল আসিম মুনিরের সাথে কাকার সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। কিছু সূত্র বলছে, এই হামলা আর্মির অভ্যন্তরীণ কলহের ফলাফল হতে পারে।
আন্তর্জাতিকভাবে এই ঘটনা নজর কাড়ছে। ভারত এবং আফগানিস্তানের সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলগুলো থেকে এই খবর ছড়িয়েছে, যা পাকিস্তানি ফ্যাক্ট-চেকাররা ‘প্রোপাগান্ডা’ বলে অভিহিত করেছে। অ্যাজাদ ফ্যাক্ট চেকের মতো প্ল্যাটফর্ম জানাচ্ছে যে, এটি ইন্দো-আফগান ষড়যন্ত্রের অংশ। তবে, অ্যাল জাজিরা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মিডিয়া এখনও এই ঘটনা নিশ্চিত করেনি। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন পাকিস্তানকে সতর্কতার জন্য বলেছে যেন নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। চীন, যারা CPEC-এর মাধ্যমে বেলুচিস্তানে বিনিয়োগ করেছে, এই ধরনের হামলায় উদ্বিগ্ন।
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কাকার ভূমিকা ছিল মৌলিক। তিনি বেলুচিস্তান অ্যাসেম্বলির সদস্য ছিলেন এবং জাতীয়তাবাদী দলের নেতা হিসেবে পরিচিত। তার সরকারের সময় মহিলাদের অধিকার এবং শিক্ষা খাতে কাজ হয়েছে, কিন্তু নিরাপত্তা সমস্যা তার সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছে। সেনেটর হিসেবে তিনি ধর্মীয় সংস্কার এবং সীমান্তবর্তী অঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেছেন। এই আক্রমণ তার রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে, বিশেষ করে আসন্ন স্থানীয় নির্বাচনের আগে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। কোয়েতার রাস্তায় নিরাপত্তা বাহিনী বাড়িয়েছে, এবং স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে। বেলুচ জাতীয়তাবাদীরা এই ঘটনাকে ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্র’ বলে দাবি করছে, যদিও প্রমাণ নেই। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ এই ঘটনার নিন্দা করে বলেছেন, “আমরা এই ধরনের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব।” বিপক্ষ দলগুলো তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
এই ঘটনা পাকিস্তানের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির প্রতিফলন। ২০২৫ সালে দেশে ইতিমধ্যে ৫০টিরও বেশি সন্ত্রাসী হামলা ঘটেছে, যা ২০২৪ সালের তুলনায় ৩০% বেশি। অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এই অস্থিরতা দেশকে আরও দুর্বল করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেলুচিস্তানের সমস্যার সমাধানের জন্য রাজনৈতিক সংলাপ দরকার, না হলে এই ধরনের ঘটনা বাড়বে।
আনওয়ারুল হক কাকার স্বাস্থ্যের খবরের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। তার পুনরুদ্ধার হলে রাজনৈতিক মহলে নতুন আলোচনা শুরু হবে। এই ঘটনা পাকিস্তানের ভবিষ্যতের একটি সংকেত, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করবে। আরও আপডেটের জন্য আমরা সতর্ক থাকব।
