কলকাতা একসময় ভারতের শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল ছিলেন, এখন তাঁর ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি একটি উদীয়মান স্টার্টআপ হাব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন। বেঙ্গালুরু এবং হায়দ্রাবাদের মতো প্রযুক্তি কেন্দ্রগুলির তুলনায় কলকাতার স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম এখনও অনেকটা পিছিয়ে থাকলেও, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী ধীরে ধীরে নিজেকে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। ২০২৫ সালে, কলকাতা-ভিত্তিক আইটি স্টার্টআপ এবং বেঙ্গল স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম বেঙ্গালুরু ও হায়দ্রাবাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। এই প্রতিবেদনে আমরা কলকাতার স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের বর্তমান অবস্থা, এর সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জগুলি বিশ্লেষণ করব।
কলকাতার স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম: একটি উদীয়মান শক্তি
কলকাতা, ‘সিটি অফ জয়’ নামে পরিচিত, শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য নয়, বরং উদ্ভাবনী স্টার্টআপের জন্যও এখন ক্রমশ পরিচিতি লাভ করছেন। স্টার্টআপ ইন্ডিয়ার তথ্য অনুসারে, পশ্চিমবঙ্গে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৫,২০০টিরও বেশি DPIIT-স্বীকৃত স্টার্টআপ রয়েছে, যার মধ্যে ২,৭০০টিরও বেশি নারী-নেতৃত্বাধীন। এই সংখ্যা ২০২৫ সালে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং কলকাতা এই ইকোসিস্টেমের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
কলকাতার স্টার্টআপ দৃশ্যে খাদ্য ও কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং ডিপটেকের মতো সেক্টরগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, SastaSundar, একটি কলকাতা-ভিত্তিক অনলাইন ফার্মেসি, ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে স্বাস্থ্যসেবা পণ্য ও ওষুধ সরবরাহে একটি শীর্ষস্থানীয় নাম হয়ে উঠেছে। এছাড়াও, StockEdge, একটি শেয়ার বাজার বিশ্লেষণ অ্যাপ, বিনিয়োগকারীদের জন্য ব্যক্তিগত আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য স্টার্টআপগুলির মধ্যে রয়েছে Invesmate, যা স্টক মার্কেট শিক্ষার জন্য আঞ্চলিক ভাষায় শিক্ষা প্রদান করে, এবং Flytant, যা ব্র্যান্ড ও ইনফ্লুয়েন্সারদের সংযোগ করে।
বেঙ্গালুরু ও হায়দ্রাবাদের সঙ্গে তুলনা
বেঙ্গালুরু ‘ভারতের সিলিকন ভ্যালি’ নামে পরিচিত, এবং হায়দ্রাবাদ, যিনি ‘টি-হাব’ এর মতো উদ্যোগের জন্য বিখ্যাত, ভারতের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে শীর্ষে রয়েছেন। বেঙ্গালুরু গত পাঁচ বছরে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগ পেয়েছে, এবং ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ২.৫৪ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে। হায়দ্রাবাদের টি-হাব এবং ফিনটেক ভ্যালি ভিজাগের মতো উদ্যোগগুলি এটিকে এআই, স্বাস্থ্য প্রযুক্তি এবং ফিনটেকের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
অন্যদিকে, কলকাতার স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম তুলনামূলকভাবে ছোট। ২০২৫ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে কলকাতা-ভিত্তিক স্টার্টআপগুলি মাত্র ২.৬৮ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে, যা বেঙ্গালুরু বা হায়দ্রাবাদের তুলনায় অনেক কম। ২০১৭ সালের প্রথমার্ধে কলকাতায় মাত্র পাঁচটি ফান্ডিং ডিল হয়েছিল, যেখানে বেঙ্গালুরু এবং দিল্লি এনসিআর-এর মতো শহরগুলি শীর্ষে ছিল। তবে, কলকাতার ইকোসিস্টেম ২০২৫ সালে ৪৫.৬% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বর্তমানে এটি বিশ্বব্যাপী ১৮৭তম স্থানে রয়েছে, যার মোট ফান্ডিং ১৪৯.৯১ মিলিয়ন ডলার।
কলকাতার শক্তি ও সম্ভাবনা
কলকাতার স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের বেশ কিছু শক্তি রয়েছে যা এটিকে বেঙ্গালুরু ও হায়দ্রাবাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে:
- সরকারি উদ্যোগ: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্টার্টআপ বেঙ্গল এবং বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি টেক হাব উদ্যোগগুলি স্টার্টআপদের জন্য ইনকিউবেশন, মেন্টরিং এবং ফান্ডিংয়ের সুযোগ প্রদান করছে। কলকাতায় স্টেট স্টার্টআপ রিসোর্স সেন্টার (SRC) এবং ২৩টি জেলায় অ্যাক্সিলারেশন সেন্টার (AC) চালু হয়েছে। এছাড়াও, ইজিয়ে বাংলা এবং শিল্প করুন বাংলা গড়ুন এর মতো উদ্যোগগুলি উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করছে।
- ইনকিউবেটর ও অ্যাক্সিলারেটর: আইআইএম কলকাতা ইনোভেশন পার্ক, নাসকম ১০কে ওয়্যারহাউস, এবং কলকাতা ভেঞ্চার্স এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলি স্টার্টআপদের জন্য মেন্টরিং, ফান্ডিং এবং নেটওয়ার্কিং সুবিধা প্রদান করছে। কলকাতা ভেঞ্চার্স, একটি ইন্ডো-ইউএস সহযোগিতা, ইতিমধ্যে ইনভেসমেট এবং ফ্লাইট্যান্ট এর মতো স্টার্টআপদের সাফল্যে সহায়তা করেছে।
- কম খরচের সুবিধা: বেঙ্গালুরু এবং হায়দ্রাবাদের তুলনায় কলকাতায় জীবনযাত্রার খরচ এবং অফিস স্থাপনের খরচ কম। এটি স্টার্টআপদের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে কাজ করছে।
- প্রতিভার ভাণ্ডার: কলকাতার আইআইটি খড়গপুর, জাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইআইএম কলকাতার মতো প্রতিষ্ঠানগুলি দক্ষ প্রতিভা সরবরাহ করছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
চ্যালেঞ্জ ও বাধা
কলকাতার স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম বেঙ্গালুরু ও হায়দ্রাবাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে:
- ফান্ডিংয়ের অভাব: বেঙ্গালুরু এবং হায়দ্রাবাদের তুলনায় কলকাতায় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল বিনিয়োগ অনেক কম। ২০০০-২০১৬ সালে ভারতে ব্রিটিশ বিনিয়োগের মাত্র ১.৩% পশ্চিমবঙ্গে এসেছে। এই বিনিয়োগের বৈষম্য কলকাতার স্টার্টআপদের বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করছে।
- উদ্যোগী সংস্কৃতির ঘাটতি: অতীতে পশ্চিমবঙ্গে উদ্যোগী সংস্কৃতির প্রতি উৎসাহের অভাব ছিল, যা ইনকিউবেটর এবং মেন্টরদের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করেছে। যদিও এখন পরিস্থিতি উন্নত হচ্ছে, তবুও এটি বেঙ্গালুরু র মতো পরিপক্ক ইকোসিস্টেমের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে।
- ইনফ্রাস্ট্রাকচার: বেঙ্গালুরু এবং হায়দ্রাবাদে উন্নত প্রযুক্তি পার্ক এবং ডেটা সেন্টারের তুলনায় কলকাতার অবকাঠামো এখনও উন্নয়নশীল। যদিও বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি এবং ওয়েবেল এর মতো উদ্যোগ অবকাঠামো উন্নত করছে, তবুও এটি বেঙ্গালুরু র আইআইএসসি বা হায়দ্রাবাদের টি-হাবের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
- ধারণার ব্যবধান: কলকাতাকে প্রায়ই শিল্প ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে দেখা হয়, প্রযুক্তি হাব হিসেবে নয়। এই ধারণা পরিবর্তন করা প্রয়োজন, যা কলকাতা ৪.০ ফাউন্ডেশনের মতো উদ্যোগের লক্ষ্য।
কলকাতার সম্ভাবনা
কলকাতার স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম বেঙ্গালুরু ও হায়দ্রাবাদের সঙ্গে পুরোপুরি প্রতিযোগিতা করতে না পারলেও, এটি নিজস্ব কুলুঙ্গি তৈরি করছে। খাদ্য ও কৃষি সেক্টরে ওএনগ্যানিক ফুডস এবং চাই ব্রেক এর মতো স্টার্টআপগুলি স্থানীয় সম্পদের উপর নির্ভর করে সাফল্য অর্জন করছে। স্বাস্থ্য প্রযুক্তি তে হেমুরএক্স এর মতো উদ্ভাবনী পণ্য এবং বেঙ্গল স্পিচ অ্যান্ড হিয়ারিং এর মতো স্টার্টআপগুলি স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। এছাড়াও, ড্রোনস টেক ল্যাব এর মতো ডিপটেক স্টার্টআপগুলি প্রতিরক্ষা এবং পৌরসভার মতো ক্ষেত্রে কাজ করছে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ১ ট্রিলিয়ন টাকার বিনিয়োগ লক্ষ্য নিয়ে বেঙ্গল সিলিকন ভ্যালি টেক হাব এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে সহযোগিতা কলকাতাকে একটি উদ্ভাবন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করছে। এছাড়াও, কলকাতার কম খরচের জীবনযাত্রা এবং প্রতিভার প্রাপ্যতা এটিকে টায়ার-২ শহরগুলির মধ্যে একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য করে তুলছে।
কলকাতার স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম এখনও বেঙ্গালুরু এবং হায়দ্রাবাদের তুলনায় প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, কিন্তু এটি দ্রুত বিকাশের পথে। সরকারি উদ্যোগ, ইনকিউবেটর, এবং স্থানীয় প্রতিভার সমন্বয়ে কলকাতা একটি উদ্ভাবনী কেন্দ্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে। যদিও ফান্ডিং এবং অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, তবুও কলকাতার স্টার্টআপ দৃশ্য স্থানীয় শক্তি এবং সরকারি সমর্থনের মাধ্যমে একটি প্রতিযোগী হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। আগামী কয়েক বছরে, আরও বিনিয়োগ এবং উদ্যোগী সংস্কৃতির প্রসারের মাধ্যমে কলকাতা ভারতের স্টার্টআপ মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করতে পারে।