বাংলার রাজনৈতিক আঙিনায় ধর্মের ব্যবহার নিয়ে বরাবরই নানা বিতর্ক থেকে এসেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের পর সেই বিতর্ক যেন আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। বাবরি মসজিদের ধ্বংসের পাল্টা হিসেবে ‘রামমন্দির’ নির্মাণ, আর এখন রাজনীতির ময়দানে একে অপরের ঘোষণাকে পাল্টা দেওয়ার নতুন কৌশল—গীতাপাঠের পাল্টা কোরান পাঠ। রাজ্য রাজনীতিতে ধর্মের জিগির তুলে ভোটের বৈতরণী পার করার যে প্রবণতা একাধিক দল গ্রহণ করেছে, তা এখন প্রকাশ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলার রাজনীতিতে ধর্ম তেমন বড় ইস্যু ছিল না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই তার মাত্রা বেড়েছে। কয়েক মাস ধরেই ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশাল গীতাপাঠের আয়োজন দেখছেন সাধারণ মানুষ। বিজেপি নেতৃত্ব বারবার বলছে, গীতা শুধু ধর্ম নয়, ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীক—এই বার্তা ছড়াতেই তাদের এই আয়োজন। রবিবার সেই গীতাপাঠে পাঁচ লক্ষ কণ্ঠ একসঙ্গে পাঠ করেন—যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হয়।কিন্তু ঠিক এই সময়েই পাল্টা সুর তুললেন ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর। ব্রিগেডে পাঁচ লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ চলাকালীনই তিনি ঘোষণা করলেন—মুর্শিদাবাদে তিনি আয়োজন করবেন এক লক্ষ মানুষের কোরান পাঠ। শুধু তাই নয়, হুমায়ুনের কথায় স্পষ্ট ইঙ্গিত, ধর্মের ময়দানেই পাল্টা মাঠ তৈরি করতে চাইছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, “গীতা পাঠ করিয়ে বিজেপি যেমন ক্ষমতা দখল করতে চাইছে, আমি ঠিক তেমনই কোরান পাঠ করিয়ে বিধানসভায় আরও বেশি মুসলিম MLA চাই।” এই মন্তব্য প্রকাশ্যে আসতেই রাজ্য রাজনীতিতে শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক। বিজেপির পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠেছে—তৃণমূল আসলে ধর্মীয় মেরুকরণকেই উৎসাহ দিচ্ছে। অন্যদিকে তৃণমূলের একাংশের মতে, হুমায়ুন কবীরের বক্তব্য দলীয় অবস্থান নয়; বরং ব্যক্তিগত মত। যদিও হুমায়ুন নিজে দাবি করেছেন—তিনি শুধু কী করতে চান তা স্পষ্ট করেছেন, এতে কোনও ভুল নেই।
মুর্শিদাবাদ বরাবরই বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক এলাকা। মুসলিম জনসংখ্যা বেশি হলেও বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পালাবদলের কেন্দ্রে থেকেছে জেলা। হুমায়ুনের এই ঘোষণার পর রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন—মুর্শিদাবাদে মুসলিম ভোট যে এখনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তা আবারও স্বীকার করে নিলেন তিনি। হুমায়ুনের বক্তব্যে মুসলিম ধর্মীয় পরিচয়কে জোর দিয়ে রাজনীতির ময়দান তৈরি করার চেষ্টা স্পষ্ট বলে অনেকে মনে করছেন। কর্মসূচি—ব্রিগেডের গীতাপাঠ ও মুর্শিদাবাদে সম্ভাব্য কোরান পাঠ—একদিকে যতটা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের উদযাপন, অন্যদিকে ততটাই ভোটের সমীকরণ তৈরি করার প্রয়াস। দলগুলি নানাভাবে ধর্মীয় পরিচয়কে সামনে এনে নিজেদের পক্ষে পরিবেশ গড়ে তুলতে চাইছে। বিবৃতি থেকে কর্মসূচি—সব জায়গায়ই তার ছাপ স্পষ্ট।
