তাইওয়ানের অর্থনীতি মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে পারে যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেমিকন্ডাক্টরের উপর শুল্ক (ট্যারিফ) আরোপ করে—এমনটাই হুঁশিয়ারি দিয়েছে তাইওয়ানের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা সংস্থা Chung-Hua Institution for Economic Research (CIER)। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন এই ট্যারিফ আরোপের সম্ভাবনা বিবেচনা করছে বলে জানা গেছে।
সেমিকন্ডাক্টরই তাইওয়ানের প্রধান রপ্তানি খাত:
তাইওয়ানের রপ্তানি নির্ভরতা মূলত সেমিকন্ডাক্টর এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT) পণ্যের উপর। সার্বিকভাবে তাইওয়ানের মার্কিন রপ্তানির ৭০ শতাংশেরও বেশি আসে এই সেক্টর থেকে, যা দেশটির অর্থনৈতিক কাঠামোর উপর এই খাতের গভীর নির্ভরতার ইঙ্গিত দেয়।
CIER-এর প্রেসিডেন্ট লিয়েন হসিয়েন-মিং বলেন,
> “অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় তাইওয়ানের জন্য সেমিকন্ডাক্টর শিল্প অর্থনৈতিক ও শিল্পোন্নয়নের দিক থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
২০২৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাইওয়ানের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ৭৩.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের ৪৭.৮ বিলিয়ন ডলার থেকে অনেক বেশি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) সার্ভার ও চিপের চাহিদা বৃদ্ধির কারণেই এই উদ্বৃত্ত বেড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
শুল্ক আরোপের হুমকি ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ:
তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তে এই ঝুঁকি স্বীকার করেছেন এবং মার্কিন পক্ষের সঙ্গে আলোচনার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি ২০ শতাংশের ট্যারিফকে “অস্থায়ী ব্যবস্থা” বলে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন এটি কমানোর জন্য জোরালো আলোচনা চালানো হবে।
CIER-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট চেন শিন-হোর্ং জানান, সেমিকন্ডাক্টরের উপর যেকোনো নির্দিষ্ট ট্যারিফ সাধারণ পণ্যের তুলনায় আরও বেশি কঠোর হতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন Section 232 of the Trade Expansion Act ব্যবহার করে এই ট্যারিফ আরোপের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি মূলত আমদানি নিরুৎসাহিত করে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ বাড়াতে একটি কৌশল হতে পারে।
টিএসএমসি-র উদ্বেগ:
বিশ্বের বৃহত্তম চিপ নির্মাতা Taiwan Semiconductor Manufacturing Company (TSMC) ইতিমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৬৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগে অ্যারিজোনায় একটি কারখানা নির্মাণ করছে এবং আগামী দিনে আরও ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু নতুন শুল্ক আরোপের আশঙ্কায় এই পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
TSMC একটি চিঠিতে মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরকে সতর্ক করে বলেছে:
> “নতুন আমদানি বিধিনিষেধ প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নেতৃত্বকেই হুমকির মুখে ফেলতে পারে।”
তদন্ত প্রতিবেদন আসছে শিগগিরই:
মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লুটনিক আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন বলে জানিয়েছেন। এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, আদৌ সেমিকন্ডাক্টরের উপর ট্যারিফ আরোপ হবে কি না।
বিশ্লেষকদের মতে, যদি এই ট্যারিফ বাস্তবায়ন হয়, তাহলে তাইওয়ান শুধু রপ্তানি ক্ষতির মুখেই পড়বে না, বরং বৈশ্বিক প্রযুক্তি সরবরাহ শৃঙ্খলেও মারাত্মক প্রভাব পড়বে। কারণ, TSMC-এর মতো কোম্পানিগুলি AI চিপ উৎপাদনে বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং এই সেক্টরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরতা অনেকাংশে তাইওয়ানের উপর নির্ভরশীল।
তাইওয়ানের অর্থনীতি কতটা ঝুঁকিতে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো ধরনের সেমিকন্ডাক্টর ট্যারিফ তাইওয়ানের GDP-র প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বর্তমানে তাইওয়ানের রপ্তানির অর্ধেকের বেশি আসে ICT ও সেমিকন্ডাক্টর খাত থেকে, ফলে এই ট্যারিফ সরাসরি হাজার হাজার চাকরি ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাইওয়ানের মধ্যে এই বাণিজ্যিক উত্তেজনা শুধুমাত্র দুই দেশের সম্পর্ককেই নয়, বরং বৈশ্বিক প্রযুক্তি বাজারকেও গভীরভাবে নাড়া দিতে পারে। ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ক্লাউড কম্পিউটিং ও মোবাইল প্রযুক্তির মতো খাতে অগ্রগতি টিকিয়ে রাখতে হলে এমন সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সাবধানে নিতে হবে।
এখন সব নজর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনের দিকে। সেটিই ঠিক করবে, সেমিকন্ডাক্টরের উপর ট্যারিফ হবে কি না, আর হলে তাইওয়ানের অর্থনীতি কোন পথে হাঁটবে।