Bangladesh 50: ‘দখলদারের থেকে প্রতিবেশীর পয়সা অনেক ভাল বাবু’

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: “এক কাপ চায়ের দাম দশ পয়সা, তার জন্য একটা দশ টাকার নোটের ভাঙ্গানী চাওয়া…। উপায় নেই, পকেট থেকে নোটটা বের করে ওর সামনে…

bangladesh liberation war

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: “এক কাপ চায়ের দাম দশ পয়সা, তার জন্য একটা দশ টাকার নোটের ভাঙ্গানী চাওয়া…। উপায় নেই, পকেট থেকে নোটটা বের করে ওর সামনে ধরলাম। বললাম, আমার কাছে তোমাদের দেশের খুচরো নেই, সবগুলোই দশ টাকার নোট। তুমি যদি একটু কষ্ট করে ভাঙ্গিয়ে দাও-
-কেন আপনার কাছে ভারতীয় পয়সা নেই? দোকানদার অপকটে বললো।
-তোমাদের এখানে ভারতীয় পয়সা চলে? আমি বিস্মিত।
-দখলদারের থেকে প্রতিবেশীর পয়সা অনেক ভাল বাবু। আজকাল ঐ চাঁদ তারা মার্কা পয়সাগুলো ছুঁতেও ঘেন্না করে। মনে হয় ওগুলো আমাদের ভেংচাচ্ছে। ওগুলোও একটা খুদে ইয়াহিয়া। …. একটা ভারতীয় দশ পয়সা ওর হাতে তুলে দিয়ে মকবুলের মোটরের দিকে এগোলাম। ” (বানান অপরিবর্তিত)

মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করতে সীমান্ত পেরিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের যশোরে ঢুকেছিলেন কলকাতার সাংবাদিক শ্যামল বসু। তাঁর স্মৃতিকথা বা যুদ্ধের ডাইরি ‘আমি মুজিবর বলছি’ বইতে সীমান্ত এলাকার কথা বর্ণনা করেছেন।

পাকিস্তান-ভারত সীমান্ত শহর যশোর। যুদ্ধ চলছিল বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা বনাম পাক বাহিনীর। শ্যামল বসু লিখছেন, ‘গাড়ী আমাদের প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলেছে। দূরে আবছা মতো দেখা যাচ্ছে যশোর শহর। দোর্দ্দণ্ডপ্রতাপ প্রতাপাদিত্যের-“যশোহর”।… হঠাৎ কামানের গোলার আওয়াজ। আমরা থেমে গেলাম। গাড়ী প্রায় মিউনিসিপ্যাল এলাকার মধ্যে প্রবেশ করেছে।
কু়ড়ি বাইশজন মুক্তিযোদ্ধা সামনের চৌরাস্তায় বাঁদিক থেকে ডানদিকে ছুটে গেল। তাদের হাতে উদ্ধত রাইফেল, বোধহয় কারো কারো হাতে স্টেনগানও আছে।
আবার গোলাবর্ষণের শব্দ।
মকবুল তার পাশে বসা দু’জন মুক্তিযোদ্ধাকে নির্দেশ দিলো, তোমরা নেমে পড়। চাঁদমারির মোড়ে পজিশন নাও। আমি এগোচ্ছি।
গাড়ী ষ্টার্ট দিল।’
সাংবাদিক শ্যামল বসুর ডাইরিতে লেখা- “আমরা সহরে মাঝে এসে পড়েছি। রাস্তাঘাট ফাঁকা, যেন শ্মশান। দোকান পাট কিছু খোলা নেই। প্রতিটি বাড়ীর জানলা দরজা বন্ধ। রাস্তায় একটা কুকুর-তাও চোখে পড়ছে না। মাঝে মধ্যে দ্রুতবেগে এক একটা জীপ গাড়ী ছুটে যাচ্ছে। তাতে বাংলাদেশের তিনরঙ্গা পতাকা। কলকাতায় সাধারণ হরতালের দিন পার্টির পতাকা লাগিয়ে রাজনৈতিক দলের গাড়ীকে যেমন ছুটোছুটি করতে দেখা যায়-এগুলো তেমনই। শুধু তফাৎ, এরা পোষাকে সৈনিক, সংকল্পে অটল।” (বানান অপরিবর্তিত)

৫০ বছর আগের কোনও এক মুক্তিযুদ্ধের দিনের কথা লিখেছেন সাংবাদিক শ্যামল বসু। ১৯৭১ সালের এই যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের যশোরে সর্বপ্রথম পাক সেনার পরাজয় হয়েছিল। ৬ ডিসেম্বর মুক্ত হয় যশোর।ভারতীয় ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণে টিকতে না পেরে যশোর সেনানিবাস থেকে খুলনায় পিছিয়ে যায় পাক সেনারা। যশোরের মাটিতে উড়ানো হয় বাংলাদেশের প্রথম পতাকা। মানুষের গগনবিদারি চিৎকার ‘জয় বাংলা’।

গুলি চলল লুটিয়ে পড়লেন চারুবালা

মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক শপথ যশোরে নেওয়া হয়েছিল ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ। যশোর কালেক্টরেটের সামনে পাক পতাকা নামিয়ে দেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে যশোরবাসী যুদ্ধের শপথ নেন। শহরের রাজপথে বের হয়েছিল মিছিল। মিছিলটি যশোর শহরের কেশবলাল রোড (এখন শহীদ সড়ক) পৌঁছলে পাক বাহিনী গুলি চালালো। গুলি লেগে লুটিয়ে পড়লেন চারুবালা ধর। চারুবালার দেহ নিয়েই শহরে মিছিল চলে। এরপর থেকেই যশোরে সংগঠিত হতে থাকে প্রতিরোধ। নেতৃত্ব দেয় সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্রজনতার সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়।