ভারতের কৃষি খাত, যা দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড এবং প্রায় ৭০% গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবিকার প্রধান উৎস, বর্তমানে একটি নতুন বিপ্লবের মুখোমুখি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি)-এর মতো উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয়ে অ্যাগ্রি-টেক স্টার্টআপগুলি (Agri-tech startups) ভারতের কৃষি খাতকে রূপান্তরিত করছে। এই স্টার্টআপগুলি কৃষকদের ফলন বৃদ্ধি, সম্পদের অপচয় কমানো, এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতি প্রচারের জন্য নতুন সমাধান নিয়ে এসেছে। ২০২৫ সালে, ভারতের অ্যাগ্রি-টেক বাজারের মূল্য ২৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছানোর পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, যা এই খাতের সম্ভাবনাকে তুলে ধরে। এই প্রতিবেদনে আমরা এমন পাঁচটি নতুন অ্যাগ্রি-টেক স্টার্টআপের কথা তুলে ধরব, যারা এআই এবং আইওটি প্রযুক্তির মাধ্যমে ভারতের কৃষিকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে।
১. ফ্যাসাল (Fasal)
২০১৮ সালে শৈলেন্দ্র তিওয়ারি এবং আনন্দ বর্মা প্রতিষ্ঠিত ফ্যাসাল একটি এআই এবং আইওটি-ভিত্তিক প্রিসিশন হর্টিকালচার প্ল্যাটফর্ম। এই স্টার্টআপ কৃষকদের জন্য রিয়েল-টাইম ডেটা প্রদান করে, যা মাটির আর্দ্রতা, তাপমাত্রা, এবং আবহাওয়ার অবস্থার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। ফ্যাসালের সেন্সর-ভিত্তিক ডিভাইসগুলি জল, কীটনাশক এবং সারের ব্যবহার অপ্টিমাইজ করে, যা ফলন বৃদ্ধি এবং উৎপাদন খরচ ২০% পর্যন্ত কমাতে সক্ষম। ২০২৩ সালে ফ্যাসাল ১২ মিলিয়ন ডলারের সিরিজ এ ফান্ডিং সংগ্রহ করেছে এবং ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছে। এই স্টার্টআপ কৃষকদের জন্য টেকসই এবং ডেটা-চালিত কৃষি সমাধান প্রদান করে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সহায়ক।
২. অ্যাগ্রিমা ইনফোটেক (Agrima Infotech)
অ্যাগ্রিমা ইনফোটেক একটি মোবাইল-ভিত্তিক অ্যাগ্রি-টেক প্ল্যাটফর্ম, যা কৃষকদের রিয়েল-টাইম ফসল পর্যবেক্ষণ এবং ব্যবস্থাপনা তথ্য প্রদান করে। এই স্টার্টআপ এআই এবং আইওটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস, মাটির পুষ্টি, এবং বাজার মূল্য সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহ করে। অ্যাগ্রিমার প্ল্যাটফর্ম কৃষকদের ফসলের চক্র পরিকল্পনায় সহায়তা করে এবং সময়মতো সংশোধনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তথ্য প্রদান করে। এই স্টার্টআপ ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী, যারা প্রায়শই প্রযুক্তির অভাবে পিছিয়ে থাকে। অ্যাগ্রিমা ইনফোটেকের লক্ষ্য হল ডিজিটাল শিক্ষার মাধ্যমে কৃষকদের ক্ষমতায়ন করা।

৩. অ্যাগ্রিওয়াইজ (Agriwyz)
২০২২ সালে প্রতিষ্ঠিত অ্যাগ্রিওয়াইজ একটি উদ্ভাবনী স্টার্টআপ, যা এআই এবং মেশিন লার্নিং-ভিত্তিক আইওটি সমাধানের মাধ্যমে কৃষিকে ডিজিটাল যুগে নিয়ে যাচ্ছে। এই স্টার্টআপ কৃষকদের জন্য টেকসই এবং উন্নত কৃষি অভিজ্ঞতা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করে। অ্যাগ্রিওয়াইজের প্ল্যাটফর্ম কৃষকদের মাটির স্বাস্থ্য, জলবায়ু ঝুঁকি, এবং ফসলের রোগ পর্যবেক্ষণে সহায়তা করে। এর আইওটি ডিভাইসগুলি রিয়েল-টাইম ডেটা সংগ্রহ করে এবং এআই অ্যালগরিদমের মাধ্যমে কৃষকদের সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। এই স্টার্টআপ বিশেষ করে জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক কৃষি পদ্ধতি প্রচারে মনোযোগ দিয়েছে, যা ভারতের কৃষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
৪. ফার্মনিড প্রো (Farmneed Pro)
ফার্মনিড প্রো একটি স্মার্টফোন-ভিত্তিক অ্যাপ, যা কৃষকদের জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক কৃষি পদ্ধতি গ্রহণে সহায়তা করে। এই স্টার্টআপ এআই এবং আইওটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের রোগ, কীটপতঙ্গ, এবং জলের চাপ ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে। ফার্মনিড প্রো-এর অ্যাপ কৃষকদের কৃষি রাসায়নিকের ব্যবহার কমাতে এবং জলের চাপ দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে সক্ষম করে। এটি ফলন বৃদ্ধি এবং উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য ডেটা-চালিত পরামর্শ প্রদান করে। এই স্টার্টআপ কৃষকদের জীবিকা রক্ষায় এবং জলবায়ু ঝুঁকির বিরুদ্ধে সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
৫. ফোরক্লাইমেট (4CLIMATE)
ফোরক্লাইমেট একটি ডিপটেক গবেষণা ও প্রযুক্তি সংস্থা, যা আধুনিক প্রিসিশন ফার্মিং প্রযুক্তির মাধ্যমে জলবায়ু-স্মার্ট খামার গড়ে তুলছে। এই স্টার্টআপ এআই এবং আইওটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকদের এবং নগর-ভিত্তিক কৃষি উৎপাদকদের জন্য টেকসই সমাধান প্রদান করে। ফোরক্লাইমেটের প্ল্যাটফর্ম মাটির স্বাস্থ্য, ফসলের গুণমান, এবং জলবায়ু ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করে। এটি কীটনাশক-মুক্ত এবং পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনের জন্য নতুন-যুগের কৃষকদের ক্ষমতায়ন করছে। এই স্টার্টআপ খাদ্য নিরাপত্তা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এই স্টার্টআপগুলির প্রভাব
এই পাঁচটি স্টার্টআপ ভারতের কৃষি খাতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনছে। ফ্যাসাল এবং ফার্মনিড প্রো-এর মতো স্টার্টআপগুলি জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় কৃষকদের সহায়তা করছে, যেখানে অ্যাগ্রিওয়াইজ এবং ফোরক্লাইমেট টেকসই কৃষি পদ্ধতির উপর জোর দিচ্ছে। অ্যাগ্রিমা ইনফোটেক কৃষকদের ডিজিটাল শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করছে, যা ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। এই স্টার্টআপগুলি কেবল ফলন বৃদ্ধি করছে না, বরং কৃষি খাতে স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং টেকসই উন্নয়ন নিয়ে আসছে।
২০২৫ সালে, ভারতের অ্যাগ্রি-টেক খাত বিনিয়োগকারীদের কাছে একটি আকর্ষণীয় ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। এই স্টার্টআপগুলি গত ১০ বছরে ২.৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি তহবিল সংগ্রহ করেছে, যা এই খাতের সম্ভাবনাকে প্রমাণ করে। এই স্টার্টআপগুলি কৃষকদের আয় বৃদ্ধি, সম্পদের অপচয় কমানো, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় সহায়তা করছে।
চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
যদিও এই স্টার্টআপগুলি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। গ্রামীণ এলাকায় ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব, উচ্চ প্রযুক্তির খরচ, এবং অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা এই প্রযুক্তির প্রসারে বাধা সৃষ্টি করছে। তবে, সরকারি উদ্যোগ যেমন স্টার্টআপ ইন্ডিয়া এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের সমর্থন এই স্টার্টআপগুলির জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে।
ভবিষ্যতে, এই স্টার্টআপগুলি কৃষি খাতে আরও উদ্ভাবন নিয়ে আসবে। উল্লেখযোগ্যভাবে, উল্লম্ব কৃষি, হাইড্রোপনিক্স, এবং জলবায়ু-স্থিতিস্থাপক ফসলের উন্নয়নের মতো প্রযুক্তি ভারতের কৃষি খাতকে আরও শক্তিশালী করবে। এই স্টার্টআপগুলি কৃষকদের কেবল উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করছে না, বরং ভারতকে বিশ্বের কৃষি শক্তিশালী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে।
ফ্যাসাল, অ্যাগ্রিমা ইনফোটেক, অ্যাগ্রিওয়াইজ, ফার্মনিড প্রো, এবং ফোরক্লাইমেটের মতো অ্যাগ্রি-টেক স্টার্টআপগুলি ভারতের কৃষি খাতে একটি নতুন যুগের সূচনা করছে। এআই এবং আইওটি প্রযুক্তির মাধ্যমে, এই স্টার্টআপগুলি কৃষকদের ডেটা-চালিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম করছে, যা ফলন বৃদ্ধি এবং টেকসই কৃষি প্রচারে সহায়তা করছে। ২০২৫ সালে, এই স্টার্টআপগুলি ভারতের কৃষি খাতকে আরও দক্ষ, লাভজনক এবং পরিবেশবান্ধব করে তুলবে।