পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয় হচ্ছে জলবায়ু-সহনশীল ফসল, কৃষকরা কী বেছে নিচ্ছেন?

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি (West Bengal Agriculture) খাত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মুখোমুখি হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা, বন্যা এবং মাটির লবণাক্ততার মতো সমস্যাগুলি কৃষকদের জন্য নতুন…

Climate-Resilient Crops Gaining Traction in West Bengal

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি (West Bengal Agriculture) খাত জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মুখোমুখি হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা, বন্যা এবং মাটির লবণাক্ততার মতো সমস্যাগুলি কৃষকদের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এই পরিস্থিতিতে, জলবায়ু-সহনশীল ফসল (climate-resilient crops) এবং ক্লাইমেট-স্মার্ট কৃষি (climate-smart agriculture) পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। এই ফসলগুলি খরা, তাপ, বন্যা এবং লবণাক্ততার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে উৎপাদন বজায় রাখতে সক্ষম। ২০২৫ সালে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা ধান, গম এবং অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী ফসলের পাশাপাশি খরা-সহনশীল এবং জলবায়ু-অভিযোজিত ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা জলবায়ু-সহনশীল ফসল এবং কৃষকদের পছন্দ নিয়ে আলোচনা করব।

জলবায়ু-সহনশীল ফসলের গুরুত্ব
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি মূলত বর্ষানির্ভর, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টির ধরণে অনিয়ম, খরার প্রকোপ এবং উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। গঙ্গার ডেল্টা অঞ্চলে বন্যা এবং উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘটনাগুলি কৃষি উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়, ভারতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদ (ICAR) এবং রাজ্য সরকার খরা-সহনশীল, বন্যা-সহনশীল এবং লবণ-সহনশীল ফসলের জাত উন্নয়ন ও প্রচারে কাজ করছে। জলবায়ু-সহনশীল ফসল কৃষকদের ফলন কমে যাওয়ার ঝুঁকি কমায় এবং খরচ কমিয়ে আয় বাড়ায়।

   

পশ্চিমবঙ্গে কৃষকরা কোন ফসল বেছে নিচ্ছেন?
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কৃষকরা তাদের স্থানীয় জলবায়ু এবং মাটির ধরনের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন জলবায়ু-সহনশীল ফসল বেছে নিচ্ছেন। নিচে কিছু জনপ্রিয় ফসল এবং তাদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল:

খরা-সহনশীল ধানের জাত (Drought-Tolerant Rice Varieties):
পশ্চিমবঙ্গে ধান প্রধান ফসল, তবে অনিয়মিত বৃষ্টির কারণে কৃষকরা খরা-সহনশীল ধানের জাত যেমন সহভাগী ধান, DRR ধান ৪২, ৪৩, এবং ৪৪ এর দিকে ঝুঁকছেন। এই জাতগুলি কম জলেও ভালো ফলন দেয় এবং খরার পরিস্থিতিতে ১.০-১.৫ টন প্রতি হেক্টর ফলন বাড়ায়। পুরুলিয়া জেলার মতো কম বৃষ্টিপাতের এলাকায় এই জাতগুলি বিশেষভাবে জনপ্রিয়। আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (IRRI) এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই জাতগুলির প্রচারে কাজ করছে।

মুগ ডাল (Green Gram):
দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলায় কৃষকরা বিরাট নামক খরা-সহনশীল মুগ ডালের জাত চাষ করছেন। এই জাতটি স্বল্প সময়ে পরিপক্ক হয় এবং কম জলের প্রয়োজন হয়। কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (KVK) এই জাতের প্রদর্শনী এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের উৎসাহিত করছে।

বাজরা (Pearl Millet):
বাজরা খরা-সহনশীল এবং পুষ্টিকর ফসল হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের শুষ্ক অঞ্চলে জনপ্রিয় হচ্ছে। এর গভীর শিকড় ব্যবস্থা কম জলেও পানি সংগ্রহ করতে সক্ষম। পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়া জেলায়, কৃষকরা বাজরা চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এটি প্রোটিন, ফাইবার এবং খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ।

মাকড় (Maize):
মুর্শিদাবাদ এবং নদিয়া জেলায় গমের পরিবর্তে মাকড় চাষ বাড়ছে। গত দশকে মাকড় উৎপাদন আটগুণ বেড়েছে, ২০১১ সালে ৩.২৫ লক্ষ টন থেকে ২০২৩ সালে ২৯ লক্ষ টনে পৌঁছেছে। মাকড় কম জলের প্রয়োজন হয় এবং খরা-সহনশীল হওয়ায় এটি গমের তুলনায় বেশি লাভজনক। রাজ্য সরকার হাইব্রিড মাকড়ের জাত প্রচার করছে।

ডাল জাতীয় ফসল (Pulses):
ডাল জাতীয় ফসল যেমন ছোলা (chickpea) এবং তুর (pigeon pea) খরা-সহনশীল এবং মাটির উর্বরতা বাড়ায়। পশ্চিমবঙ্গে ডাল উৎপাদন গত দশকে তিনগুণ বেড়েছে। এই ফসলগুলি কম সেচের প্রয়োজন হয় এবং পুষ্টির দিক থেকে সমৃদ্ধ।

Advertisements

তৈলবীজ (Oilseeds):
তৈলবীজ যেমন সরিষা এবং তিল পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকায় জনপ্রিয়। এই ফসলগুলি লবণাক্ত মাটিতে ভালো জন্মে এবং কম জলের প্রয়োজন হয়। তৈলবীজ উৎপাদন গত দশকে দ্বিগুণ হয়েছে।

দেশীয় ধানের জাত (Folk Rice Varieties – FRVs):
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা দেশীয় ধানের জাত (FRVs) যেমন কুরুভা এবং রক্তশালী চাষ করছেন। এই জাতগুলি খরা, বন্যা এবং কীটপতঙ্গ প্রতিরোধী। পশ্চিমবঙ্গে ১৬টি জেলায় ৫,০০০-এর বেশি কৃষক ১৫০টি দেশীয় ধানের জাত চাষ করছেন, যা ১,১৮,১৮৫ হেক্টর জমিতে বিস্তৃত। এই ধানগুলি রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয় না এবং প্রাকৃতিক কৃষি পদ্ধতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

কেন কৃষকরা এই ফসল বেছে নিচ্ছেন?
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা জলবায়ু-সহনশীল ফসলের দিকে ঝুঁকছেন কয়েকটি কারণে:

  • খরা ও বন্যার ঝুঁকি: পুরুলিয়ার মতো এলাকায় কম বৃষ্টিপাত এবং উপকূলীয় এলাকায় বন্যার ঝুঁকি কৃষকদের খরা- এবং বন্যা-সহনশীল ফসল বেছে নিতে উৎসাহিত করছে।
  • কম খরচ: দেশীয় ধান এবং ডাল জাতীয় ফসল রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের প্রয়োজন কমায়, যা কৃষকদের খরচ কমায়।
  • বাজারের চাহিদা: মাকড় এবং তৈলবীজের মতো ফসল পোলট্রি এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে ভালো দাম পায়, যা কৃষকদের আয় বাড়ায়।
  • সরকারি সহায়তা: ICAR, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (KVK) এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকার কৃষকদের প্রশিক্ষণ, বীজ বিতরণ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করছে।

ক্লাইমেট-স্মার্ট কৃষির ভূমিকা
ক্লাইমেট-স্মার্ট কৃষি (CSA) পশ্চিমবঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই পদ্ধতি উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর উপর জোর দেয়। পশ্চিমবঙ্গে CSA-এর কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হল:

  • জল সংরক্ষণ: ড্রিপ সেচ এবং বৃষ্টির জল সংগ্রহের মতো পদ্ধতি জলের ব্যবহার কমাচ্ছে।
  • জৈব কৃষি: দেশীয় ধান এবং জৈব পদ্ধতির ব্যবহার মাটির উর্বরতা বাড়াচ্ছে।
  • ফসল বৈচিত্র্যকরণ: ধানের পাশাপাশি মাকড়, ডাল এবং তৈলবীজ চাষ কৃষকদের ঝুঁকি কমাচ্ছে।
  • প্রশিক্ষণ ও প্রচার: কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র এবং স্থানীয় এনজিও কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পথ
জলবায়ু-সহনশীল ফসলের জনপ্রিয়তা বাড়লেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

  • বীজের প্রাপ্যতা: নতুন জাতের বীজ সহজলভ্য করতে আরও কার্যকর বিতরণ ব্যবস্থা প্রয়োজন।
  • কৃষকদের সচেতনতা: অনেক কৃষক এখনও জলবায়ু-সহনশীল ফসলের উপকারিতা সম্পর্কে অবগত নন।
  • অর্থনৈতিক ঝুঁকি: নতুন ফসল চাষে প্রাথমিক বিনিয়োগ এবং বাজারের অনিশ্চয়তা কৃষকদের দ্বিধাগ্রস্ত করে।

ভবিষ্যতে, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র, সরকার এবং এনজিও-এর মাধ্যমে আরও প্রশিক্ষণ, বীজ বিতরণ এবং আর্থিক সহায়তা কৃষকদের এই ফসল গ্রহণে উৎসাহিত করবে।

পশ্চিমবঙ্গে জলবায়ু-সহনশীল ফসল যেমন খরা-সহনশীল ধান, মুগ ডাল, বাজরা, মাকড়, ডাল এবং তৈলবীজ কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হচ্ছে। এই ফসলগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক এবং কৃষকদের আয় ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। ক্লাইমেট-স্মার্ট কৃষি পদ্ধতি এবং সরকারি সহায়তার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষকদের জন্য এই ফসলগুলি শুধুমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার নয়, বরং তাদের জীবিকার উন্নতির পথও।