Bengal offline shopping: অনলাইনে বাজার করার চল যখন সারা বিশ্বে বিপুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, তখনও বাংলার মানুষ তাঁদের পুরনো অভ্যাস ছাড়তে রাজি নন। আজও তাঁরা বেশি ভরসা করেন পাড়ার পরিচিত মুদি দোকান, যেখানে আছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, সুরক্ষা ও অভ্যাসের আশ্বাস। এই চিত্র একদিকে যেমন পুরনো দিনের নস্টালজিয়াকে সামনে আনে, তেমনই আবার অনিকেত চট্টোপাধ্যায়ের ২০১৯ সালের সিনেমা শঙ্কর মুদি-কে বাস্তবের সঙ্গে মেলায়।
শঙ্কর মুদি সিনেমায় পরিচালক অনিকেত তুলে ধরেছিলেন শপিং মল সংস্কৃতির অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত এক সাধারণ খুচরো ব্যবসায়ীর কাহিনি। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় অভিনীত শঙ্কর নামের চরিত্রটি ছিল ছোটবেলার পরিচিত পাড়ার মুদি দোকানদারের প্রতীক। ঝাঁ-চকচকে মলের ভিড়ে সেই শঙ্কররা হারিয়ে যেতে বসেছিল। অথচ সিনেমা মুক্তির ছ’বছর পর এক সমীক্ষা বলছে, বাঙালির এখনও ভরসা সেই শঙ্কর মুদির মতো ছোট ব্যবসায়ীরা।
সম্প্রতি মোর রিটেল-এর এক সমীক্ষা ও বিশ্লেষণে উঠে এসেছে চমকপ্রদ তথ্য। সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর বিনোদ নাম্বিয়ার জানান, দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে এখনও অধিকাংশ মানুষ বাজার করতে দোকানেই যেতে বেশি স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন। দেশে যেখানে মুদি দোকানে গিয়ে কেনাকাটার গড় বিল ৪০০-৪৫০ টাকার মধ্যে, সেখানে বাংলায় এই অঙ্ক ৫০০-৫৩০ টাকা। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের ক্রেতারা প্রায়শই দোকান থেকে বেশি দামে, কিন্তু বেশি পরিমাণে জিনিস কিনছেন। অন্যদিকে অনলাইনে কেনাকাটার গড় বিল দেশে যেখানে প্রায় ৯০০ টাকা, বাংলায় তা মাত্র ৭০০-৭৫০ টাকা।
এই তফাৎ থেকেই পরিষ্কার, রাজ্যের মানুষের কাছে দোকানে যাওয়ার অভ্যেস ও পছন্দ এখনও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু অভ্যাসই নয়, খুচরো বিক্রেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, জিনিসপত্র দেখে নেওয়ার সুযোগ, দরাদরি করার সুবিধা— এসব কারণেই অনলাইন শপিংয়ের যুগেও শঙ্কর মুদিরা তাঁদের স্থান ধরে রেখেছেন।
মোর রিটেল বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ১০৯টি বিপণি চালাচ্ছে। এর মধ্যে ৪৫টি সরাসরি অ্যামাজ়ন ইন্ডিয়ার অনলাইন প্ল্যাটফর্মে দৈনন্দিন ভোগ্যপণ্য জোগান দেয়। বিনোদ নাম্বিয়ার মতে, “বাংলার মানুষ অন্য রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি সংযুক্ত থাকেন তাঁদের স্থানীয় দোকানের সঙ্গে। এই আচরণগত পার্থক্য আমাদের ব্যবসার পরিকল্পনাতেও প্রভাব ফেলছে।” সে কারণেই আগামী দু’বছরের মধ্যে রাজ্যে আরও ৯০টি নতুন মোর বিপণি খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিস্কুট, তেল, সাবান, চা, কফি, শ্যাম্পু, পনির, চিজের মতো ছোট ছোট ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে আজও রাজ্যের মানুষ চটজলদি অনলাইন ক্লিক নয়, বরং দোকানে গিয়ে হাতে জিনিস দেখে, পছন্দ করে কিনতেই বেশি আগ্রহী। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এই প্রবণতা আরও স্পষ্ট। এতে যেমন ছোট ব্যবসায়ীরা টিকে থাকার সাহস পান, তেমনই বৃহৎ অনলাইন সংস্থাগুলিকেও রাজ্যে ব্যবসা করতে স্থানীয় স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এগোতে হচ্ছে।
এই প্রবণতা শুধু অর্থনীতির চোখে দেখলে ভুল হবে। এটি বাঙালির মননের, অভ্যাসের এবং স্থানীয় সমাজ ব্যবস্থারই এক প্রতিচ্ছবি। এমনই এক সময়ে শঙ্কর মুদি সিনেমাটি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে— যেখানে আধুনিকতার স্রোতে গিয়ে হারিয়ে না গিয়ে, ছোট ছোট সম্পর্কের দৌলতে টিকে থাকে এক মানবিক ব্যবসা মডেল।
অর্থাৎ, যান্ত্রিক অনলাইনের জোয়ারে যখন বহু শহরে পরিচিত দোকান উধাও, তখনও কলকাতা ও বাংলার শহরতলি থেকে গ্রাম— সর্বত্র শঙ্কর মুদিরা রয়ে গিয়েছেন মানুষের ভরসার শেষ ঠিকানা।